কোথায় গেল ৮৪৬ কোটি টাকার কয়লা

0

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে কয়লা তোলার কাজটি করে চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি কনসোর্টিয়াম। এই কনসোর্টিয়ামকে গত ১৩ বছরে (২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত) ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার টন কয়লা তোলার বিল দিয়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে খনি কর্তৃপক্ষ আরও পাঁচ লাখ টন বেশি কয়লা পেয়েছে। কাগজে-কলমে এর হিসাব রাখেনি খনি কর্তৃপক্ষ, যার বাজারমূল্য ৮৪৬ কোটি টাকার বেশি। এই টাকার পুরোটাই আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

খনি থেকে তোলা কয়লা ভেজা থাকে। সেই কয়লায় পানি বা আর্দ্রতা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি থাকলে তার মূল্য দেওয়া হয় না। চীনা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ৫ দশমিক ১ শতাংশ পানিসহ (আর্দ্রতা) কয়লা কিনেছে বিসিএমসিএল। কিন্তু খনির পাশে অবস্থিত বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে ও খোলাবাজারে ১০ শতাংশের বেশি আর্দ্রতাযুক্ত কয়লা বিক্রি করেছে বিসিএমসিএল। এই অবস্থায় ৫ শতাংশ আর্দ্রতা বাড়ায় ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার টন কয়লার বাড়তি হয়েছে আরও পাঁচ লাখ টনের বেশি। এই বাড়তি পাঁচ লাখ টন কয়লার দাম প্রায় ৮৪৬ কোটি টাকা (খোলাবাজারে প্রতি টন কয়লার দাম ১৬ হাজার ৯২৭ টাকা)। এই টাকা খনি কোম্পানির তহবিলে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে জ্বালানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, কম আর্দ্রতায় কয়লা কিনে তা বেশি আর্দ্রতায় ​কীভাবে বিক্রি করল, সেটা একটি বড় প্রশ্ন। তা ছাড়া খনি থেকে কয়লা আত্মসাৎ করার বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে। দুদক আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হলে জ্বালানি খাত দুর্নীতিমুক্ত করার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে।

চুরির ঘটনা যেভাবে সামনে আসে
২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রথমবারের মতো ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা খোয়া যাওয়ার কথা স্বীকার করে বিসিএমসিএল। তখন বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এই কেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ করত বিসিএমসিএল। তখনই জানা যায়, খনির মুখে প্রায় দেড় লাখ টন কয়লার হদিস নেই। এ ঘটনায় কয়লা ‘চুরি’ গেছে উল্লেখ করে মামলা করা হয়। এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদক মামলার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, খোয়া যাওয়া কয়লা খনি কর্মকর্তারাই আত্মসাৎ করেছেন। এসব কয়লা খনির গেট দিয়ে ট্রাক করে বেরিয়ে গেছে। অভিযোগপত্রে কয়লা আত্মসাতের জন্য খনির সাত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়ী করা হয়েছে। তাঁরা হলেন মো. মাহবুবুর রহমান, খুরশীদুল হাসান, মো. আমিনুজ্জামান, মো. কামরুজ্জামান, আবদুল আজিজ খান, এম নুরুল আওরঙ্গজেব ও হাবিব উদ্দিন আহামদ। তাঁদের মধ্যে হাবিব উদ্দিন আহামদকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে পেট্রোবাংলা। এম নুরুল আওরঙ্গজেবকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। অবসরে গেছেন মো. মাহবুবুর রহমান, খুরশীদুল হাসান ও মো. আমিনুজ্জামান। মো. কামরুজ্জামান এখন সরকারি সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির (আরপিজিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মো. আবদুল আজিজ খান বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য।

খনি কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত যত কয়লা কিনেছে, তার চেয়ে ৫ লাখ টন বেশি পেয়েছে।

আবদুল আজিজ খানকে কেন সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি, জানতে চাইলে ১৫ অক্টোবর বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘তাঁকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা আমার নেই। এটি মহামান্য রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। রাষ্ট্রপতির কাছে জ্বালানি বিভাগ তাঁর বরখাস্তের সুপারিশ করবে। এরপর সেটি মহামান্য রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেবেন।’

এদিকে দুদক আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর এ মাসের ১৫ তারিখ সাবেক ৭ এমডিসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর মধ্যে হাবিব উদ্দিনসহ বিসিএমসিএলের তিন কর্মকর্তা কারাগারে রয়েছেন। বাকিরা জামিনে আছেন।

১৩ বছরে ৫ লাখ টন কয়লা বাড়তি পেয়েছে খনি কর্তৃপক্ষ, কিন্তু তার হিসাব কেন রাখা হয়নি, এই প্রশ্নের জবাবে বিসিএমসিএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুজ্জামান খান গত ২৫ সেপ্টেম্বর মুঠোফোনে বলেন, ‘এই খনিতে আমি অল্প কিছুদিন আগে দায়িত্ব পেয়ে এসেছি। এসব বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। সে কারণে আমি কিছু বলতে পারছি না।’

এদিকে বিসিএমসিএল বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে চুক্তির বাইরে বেশি পানিযুক্ত কয়লা সরবরাহ করছে, এমন অভিযোগ পাওয়ার পর গত ৪ মার্চ বিদ্যুৎ বিভাগ একটি বৈঠক করে। ‘বিসিএমসিএল থেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহকৃত কয়লায় মাত্রাতিরিক্ত আর্দ্রতার কয়লার বিল সমন্বয়’ শীর্ষক ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যুৎ-সচিব আহমেদ কায়কাউস। ওই বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুযায়ী খনির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ১০ শতাংশ পানিসহ কয়লা কিনবে বিদ্যুৎকেন্দ্র। অথচ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খনি থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা কয়লায় গড়ে আর্দ্রতা পাওয়া গেছে ১৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যা নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় বিলের সঙ্গে সমন্বয় করা উচিত। এ ছাড়া কয়লার সঙ্গে আয়রন উপাদান থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষতি হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক ও জ্বালানিবিশেষজ্ঞ বি ডি রহমতউল্লাহ  বলেন, বড়পুকুরিয়ার কয়লা চুরির পেছনে খনি কোম্পানির লোকজন জড়িত। তাঁদের ছাড়া এই কয়লা চুরি সম্ভব নয়। সরকারের উচিত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদা না দেখে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত সত্য বের করা।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com