৫ শ টাকার গগলস ৫০০০, ২ হাজারের পিপিই ৪৭০০
দেশের স্বাস্থ্য খাত কতটা নড়বড়ে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর তা উন্মোচিত হয়েছে। পর্যাপ্ত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) অভাবে করোনায় আক্রান্ত রোগী মারা যাচ্ছে। নেই যথেষ্টসংখ্যক মানসম্পন্ন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই)। স্বাস্থ্য সরঞ্জামের অভাবে করোনায় আক্রান্তদের সেবা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। এমন বাস্তবতায় বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে পিপিই, ভেন্টিলেটর, মাস্ক, গগলসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় যে খরচ ধরা হয়েছে, তা বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে দুই থেকে চার গুণ বেশি।
এ ছাড়া চলমান মানবিক দুর্যোগের সময় যেখানে চিকিৎসা উপকরণের দিকে জোরালো নজর দেওয়া দরকার, সেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশি ঝোঁক চিকিৎসাবহির্ভূত খাতে। চিকিৎসা সরঞ্জামে যত টাকা খরচ করা হচ্ছে, তার চেয়ে তুলনামূলক বেশি টাকা খরচ হচ্ছে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, সেমিনার, কনফারেন্স ও পরামর্শক খাতে।
করোনা সংকট মোকাবেলায় স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে এখন পর্যন্ত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় দুটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ৮৫০ কোটি টাকা। বাকি ২৭৭ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এডিবির অর্থায়নে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিবির ঋণ ৮৫০ কোটি টাকা। বাকি ৫১৫ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। এরই মধ্যে দুটি প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্প দুটিতে আছে ব্যাপক ত্রুটিবিচ্যুতি। টাকা খরচের ক্ষেত্রে আছে দ্বৈততা। অর্থ অপচয়ের আছে প্রচুর সুযোগ। প্রকল্প দুটিতে যে খরচ দেখানো হয়েছে, তাতে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনও। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। খরচ কমানো যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জরুরি সহায়তা’ শিরোনামের প্রকল্পটির আওতায় এক লাখ সেফটি গগলস কেনা হবে। প্রতিটি সেফটি গগলসের দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে প্রতিটি সেফটি গগলস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায়। এই প্রকল্পের আওতায় মোট এক লাখ সাত হাজার ৬০০ পিপিই কেনা হবে। যার প্রতিটির জন্য খরচ ধরা হয়েছে চার হাজার ৭০০ টাকা। পিপিই কেনায় মোট খরচ হবে ৫০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব শর্ত মেনে ওষুধ অধিদপ্তরের সব শর্ত অনুসরণ করে বিভিন্ন কম্পানির তৈরি ভালো মানের পিপিই বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দুই হাজার টাকায়। এই প্রকল্পের আওতায় ৭৬ হাজার ৬০০ জোড়া বুট শু কেনা হবে। প্রতিটি শুর খরচ দেখানো হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা। এই খাতে খরচ ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। দেশে বর্তমান বাজারে বুট শু ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় মিলছে।
জানতে চাইলে বেক্সিমকো ফার্মার চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা বলেন, ‘জিএসএম ৭০’ পিপিই দেশের বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ওষুধ অধিদপ্তরের সব শর্ত মেনেই মানসম্পন্ন পিপিই উৎপাদন ও সরবরাহ করছে বেক্সিমকো।
পিপিই ও গগলস উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সফট-বাংলার স্বত্বাধিকারী কুদরত এলাহী লিটন বলেন, প্রতিটি পিপিইর দাম এক থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। এসব পিপিই আন্তর্জাতিক মানের। দুই হাজার টাকার বেশি কোনো পিপিই নেই। এ ছাড়া প্রতিটি ভালো মানের সুরক্ষা গগলস বিক্রি হয় ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে করোনা মোকাবেলার প্রকল্পে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার চেয়ে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, সেমিনার, কনফারেন্স ও পরামর্শক খাতে তুলনামূলক বেশি খরচ হচ্ছে। গবেষণার জন্য খরচ হবে ২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ইনোভেশন নামের আলাদা একটি খাত তৈরি করে সেখানে ৩৬ কোটি টাকা খরচ করা হবে। চলমান করোনা সংকটের মধ্যে যেখানে সব কিছু স্থবির, সেখানে এই প্রকল্পে ভ্রমণ ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। মাত্র ৩০টা অডিও-ভিডিও ফিল্ম তৈরির খরচ দেখানো হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৮০টা সেমিনার ও কনফারেন্স করে খরচ করা হবে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। সবচেয়ে বেশি অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে ওয়েবসাইট উন্নয়ন খাতে। মাত্র চারটি ওয়েবসাইট উন্নয়ন করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খরচ হবে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাঁচটি ডাটাবেইস তৈরিতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাঁচটি কম্পিউটার সফটওয়্যার কেনায় খরচ ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৩০টি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য খরচ হবে আরো ৪৫ কোটি টাকা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের আনা-নেওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া নেওয়া হবে। সেই গাড়িভাড়া বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা। দেশে যতগুলো স্থলবন্দর আছে, সেখানে যাতায়াত করা মানুষের শরীরের তাপমাত্রা দেখতে নির্মাণ করা হবে অনাবাসিক ভবন। সেসব ভবন নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে ১৯০ কোটি টাকা।
এমন খরচের হিসাব দেখে বিস্মিত পরিকল্পনা কমিশনও। কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিকালে প্রকল্পটি দ্রুত অনুমোদন দরকার, তাই চিকিৎসা সরঞ্জামের তুলনায় এসব খাত অনাবশ্যক হওয়া সত্ত্বেও প্রকল্পটি অনুমোদন করতে হয়েছে কমিশনের কর্মকর্তাদের।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব পদমর্যাদার) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অনাবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য যে ১৯০ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে, আমরা জানতে চেয়েছি এই খরচ কোন প্রক্রিয়ায় দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমরা সদুত্তর পাইনি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আমরা প্রকল্পটি অনুমোদন করেছি। এখন দেখছি অনেক খাতে যে খরচ ধরা হয়েছে, সেটা বেশি মনে হচ্ছে। তবে এখনো সংশোধনের সুযোগ আছে। আমরা প্রকল্পে খরচ কমিয়ে আনতে পারি।’
এডিবির অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পটির নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পে প্রাক্কলন করা খরচের সঙ্গে বেশ কিছু অসংগতি রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্পটিতে অডিও-ভিডিও ফিল্মে যেখানে খরচ দেখানো হয়েছে ১১ কোটি টাকা, এডিবির অর্থায়নের প্রকল্পটিতে একই খাতে খরচ ধরা হয়েছে মাত্র এক কোটি ৫৫ লাখ টাকা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পে গবেষণা খাতে খরচ দেখানো হয়েছে ২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা, এডিবির অর্থায়নের প্রকল্পটিতে সমজাতীয় খাতে খরচ দেখানো হয়েছে মাত্র চার কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া পাঁচটি কম্পিউটার সফটওয়্যার কেনায় খরচ দেখানো হয়েছে ৫০ লাখ টাকা, যেখানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্পটিতে সমানসংখ্যক সফটওয়্যার কেনার খরচ ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। এডিবির অর্থায়নে এই প্রকল্পের আওতায় সেমিনার কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপ খাতে ৪৫ কোটি টাকা ধরা আছে।
এডিবির অর্থায়নের প্রকল্পটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ২০০ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রক্রিয়ায় এই টাকা খরচ ধরা হয়েছে, পরিকল্পনা কমিশনকে সদুত্তর দিতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
জানা গেছে, এডিবির অর্থায়নের প্রকল্পের আওতায় অগ্রগামী যোদ্ধা চিকিৎসক ও নার্সদের ঝুঁকিভাতা হিসেবে ৩৩৫ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। অথচ সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে পদ অনুযায়ী প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এখানেও দ্বৈততা দেখা যাচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প দুটির পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক ড. ইকবাল কবির বলেন, ‘চিকিৎসক ও নার্সদের ঝুঁকিভাতা হিসেবে আমরা যে টাকা ধরেছি, সেটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চিকিৎসক ও নার্সদের ঝুঁকিভাতা দেওয়া হবে।’ বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে পিপিইর দামের ফারাকের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. ইকবাল কবির বলেন, ‘কডিভ-১৯ যখন বাংলাদেশে শনাক্ত হয়, তখন তো কেউ পিপিই, গগলস—এসব সম্পর্কে জানত না। খরচও জানা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজার দেখে দাম ঠিক করা হয়েছিল। অনেক পরে দেশে এসব পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে। তাই দামে তারতম্য হচ্ছে। আমরা একটা দাম ধরেছি। যখন কিনতে যাব, তখন খরচ নিশ্চয়ই অনেক কম হবে। বেশি দাম ধরা মানে তো কিনে ফেলা নয়।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ঋণ নিয়ে এগিয়ে এসেছে এটি ভালো খবর। কিন্তু তাদের ঋণের টাকা কোথায় খরচ হয়, সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা জরুরি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিটি গগলস ও পিপিইর জন্য যে টাকা খরচ দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে বাজারমূল্যের কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে। তাই বলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হতে পারে না। চলমান দুর্যোগের সময় সরকারকে টাকা খরচে আরো সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি যাতে কার্যকর হয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটায় খরচ যেন বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে, সেদিকেও নজর দিতে হবে।’