মুছে ফেলা হচ্ছে ক্যাসিনো কলঙ্ক!
আলোচিত ক্যাসিনো কারবারিরা কারাগারেও আরাম-আয়েশে আছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, তারা কারা কর্র্তৃপক্ষ ‘ম্যানেজ করে’ ভালোভাবেই থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। পাশাপাশি ‘দেন-দরবার করে’ জামিনে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যে ক্যাসিনো কারাবারে জড়িত দুই প্রভাবশালী বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া এবং কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম (ফিরোজ) জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। ক্যাসিনো কারবারের আরেক ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ অন্তত ১০ জন জামিনে মুক্ত হতে নানা ‘দেন-দরবার’ চালাচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্যাসিনো কারবারিদের গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা আছেন বহাল তবিয়তে। ‘তদবির’ চালিয়ে তারাও পার পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাছাড়া অনেক দিন নেই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। অথচ নিয়মিত অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। অনেক কারবারিই প্রকাশ্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আবার কেউ দেশের বাইরে পাড়ি দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে র্যাব। সেদিন সন্ধ্যায় রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ক্যাসিনো কারবারিদের অন্যতম ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। উদ্ধার করা হয় বিপুল অর্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র। তাকে গ্রেপ্তারের পর তোলপাড় শুরু হয় দেশ-বিদেশে। ওইদিন রাতেই মতিঝিল ক্লাবপাড়ায়ও চালানো হয় বিশেষ অভিযান। গ্রেপ্তারের দিনই খালেদের কাছ থেকে পাওয়া যায় ‘চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য’। পরে রিমান্ডে খালেদ তার অনেক সহযোগী ও আশ্রয়দাতাদের নাম ফাঁস করে দেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি (বহিষ্কৃত) সম্রাট। এছাড়া যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাসহ ঢাকা সিটি করপোরেশনের অনেকের নাম বলেছেন খালেদ। পরে একে একে গ্রেপ্তার করা হয় সম্রাট ও শামীমসহ অন্তত ১০ জনকে। এসব ক্যাসিনো কারবারির সঙ্গে যেসব ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ‘সুসম্পর্ক’ ছিল তাদের কয়েকজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছেন সিটি করপোরেশনের কতিপয় কাউন্সিলর। তাদের অত্যাচারে এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ থাকতেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি (বহিষ্কৃত) সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগ নামধারী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীম, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়াসহ অন্যদের সঙ্গে তাদের ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাদের আশকারায় দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এসব কাউন্সিলর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ ও র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, গত ১৯ মার্চ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া কাশিমপুর-১ থেকে ও ১ জানুয়ারি শফিকুল আলম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান। তাদের মুক্ত হওয়ার বিষয়টি প্রথমে তারা জানতে পারেননি। যখন জেনেছেন তখন আর করার কিছুই ছিল না। ওই কর্মকর্তারা জানান, গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর তেজগাঁওয়ের মণিপুরীপাড়ার বাসা থেকে লোকমান হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ২২ সেপ্টেম্বর শফিকুল আলমকে কলাবাগান ক্রীড়া চক্র ক্লাব থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকের মামলা করা হয়। সম্প্রতি এসব মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্রাটসহ অন্যরা জামিন নিয়ে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে তারা মুক্ত হতে লবিং করছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। এমনকি কেউ কেউ অসুস্থ না হয়েও কারা হাসপাতালে থাকছেন। কারাগারের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে ম্যানেজ করে আরাম-আয়েশেই আছেন তারা। পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ক্যাসিনো কারবারিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের সহকর্মীও আছেন। তাদের ব্যাপারেও আমরা কোনো অ্যাকশনে যেতে পারিনি।’
হাসপাতালেই আছেন সম্রাট-শামীম : ক্যাসিনোকা-ে গ্রেপ্তারদের মধ্যে কেউ কেউ চিকিৎসার নামে মাসের পর মাস থাকছেন হাসপাতালের কেবিনে। এদের মধ্যে সম্রাট সাত মাস এবং জি কে শামীম প্রায় দুই মাস ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কেবিনে আছেন। কেন্দ্রীয় কারাগারের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সম্রাট ও শামীমকে আদালতের নির্দেশে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়। কারারক্ষীদের তত্ত্বাবধানে তাদের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসা শেষে তাদের কারাগারে ফেরত পাঠাতে বিএসএমএমইউকে চিঠি দিয়েছে কারা প্রশাসন। কিন্তু তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি বিলম্ব হচ্ছে। বিএসএমএমইউর হৃদরোগ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক চৌধুরী মেসকাত আহম্মেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সম্রাটের হৃৎস্পন্দনের অনিয়মের কারণে তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত বছর ৬ অক্টোবর কারাগারে আসার এক দিন পর তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পর সমালোচনার মুখে তাকে কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর গত ২৪ নভেম্বর আবার তাকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ৫ এপ্রিল জি কে শামীমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার হাতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। কিন্তু তিনি তার ডান হাতের ক্ষতস্থান থেকে প্লেট অপসারণ করতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যাচ্ছে না। কারা হাসপাতালের চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান জানিয়েছেন, জি কে শামীমের ডান হাতে একটি ক্ষতের স্থানে প্লেট বসানো আছে। সেখানে ব্যথার কারণে তাকে বিএসএমএমইউর অর্থোপেডিক বিভাগে স্থানান্তর করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছর ক্যাসিনোবিরোধী ও শুদ্ধি অভিযানের সময় বন্যপ্রাণী আইনে তাৎক্ষণিক ছয় মাসের সাজা দেওয়া হয় সম্রাটকে। সে সাজা খেটে শেষ করেছেন তিনি। রমনা থানার অস্ত্র ও অর্থপাচার মামলায় তিনি কারাগারে আছেন। তিনিও যেকোনো সময় জামিনে বের হয়ে আসবেন। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল, পুরান ঢাকার আওয়ামী লীগের নেতা সহোদর এনামুল ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়াও জামিনে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব, সাবেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান, অনলাইনে ক্যাসিনোর জনক সেলিম প্রধানও জামিনের চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিত করেছি এবং তারা যেন জামিন নিয়ে মুক্ত হতে না পারেন সে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকার দক্ষিণ ও উত্তর সিটির সাবেক ও বর্তমান ১২ কাউন্সিলরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কালো তালিকাভুক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ওইসব কাউন্সিলর তদবির করে অনেকটা পার পেয়ে গেছেন। তাছাড়া যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকে নজরদারির আওতায় আনা হলেও এখন তারা সেই নজরদারিতে নেই। তারা প্রকাশ্য ঘুরছেন। কেউ কেউ দেশের বাইরে চলে গেছেন।