ইসলামফোবিয়া: ভারতের ওপর চোখ রাখছে উপসাগরীয় দেশগুলো
গত কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্ক ব্যাপকভাবে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আর এই অঞ্চলের প্রধান দুই পরস্পর বৈরী দেশ ইরান ও সৌদি আরবের সাথে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক রক্ষা করেই এই সাফল্য পেয়েছে ভারত। একটি রাখ-ঢাকহীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের জন্য এটি কম কোনো অর্জন নয়। বিশেষ করে যদি একথা বিবেচনা করা হয় যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবেই ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের ঐতিহাসিক অংশীদার। কিন্তু গত ৫ বছর ধরে আগের সরকারের প্রয়াসের ওপর ভিত্তি করে নয়া দিল্লি এত সতর্কভাবে যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিল তা এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। ভারতের ২০ কোটি মুসলমানকে টার্গেট করে অভ্যন্তরীণ ঘটনাগুলো দেশটির কূটনৈতিক কৃতিত্বকে মুছে দিতে শুরু করেছে।
সরকারি খবরে বলা হচ্ছে যে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এখন পর্যন্ত ভারতের জনসংখ্যার ওপর সীমিত প্রভাব ফেলেছে। তুলনামূলক কম সংখ্যক আক্রান্ত বা মৃত্যুবরণ করলেও করোনাভাইরাস সঙ্কটে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় অনলাইন ও শারীরিক আক্রমণের শিকার হচ্ছে। আর এসব ঘটনায় ক্ষমতাসীন বিজেপির সদস্যরা জড়িত রয়েছে। আক্রমণটি এসেছে নয়া দিল্লির নিজামুদ্দিনে মার্চের শুরুর দিকে একটি সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। তখন ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন দেশ সমাবেশের ওপর বিধিনিষেধ জারি করতে শুরু করেছিল। সম্মেলনে কয়েকটি দেশের অতিথিসহ প্রায় তিন হাজার লোক ঘিঞ্জি স্থানে সমবেত হওয়ায় করোনাভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একে ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের একটি প্রধান উৎস বিবেচনা করা হচ্ছে। ভাইরাসটি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের সভা আয়োজনের যৌক্তিকতা থাকে সামান্য। কিন্তু পুরো ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়কে এজন্য প্রকাশ্যে ও নির্লজ্জভাবে দায়ী করার ফলে মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সতর্কভাবে প্রণীত কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রিন্সেস হেন্দ আল-কসিমি বিরল এক প্রকাশ্য পদক্ষেপ গ্রহন করে ভারতীয়দের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিয়া নিয়ে তার অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। তিনি ৪ মে ট্যুইট করেন, আমি শান্তিপূর্ণ ভারতকে মিস করছি। তিনি এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আমিরাতে বসবাসকারী এক ভারতীয় নাগরিকের টুইটের প্রতিক্রিয়ায়। হেন্দ আল কসিমি ওই টুইটকে ‘স্পষ্টভাবে বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তার অনুসারীদের বলেন যে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের শাস্তি হতে পারে জরিমানা এবং এমনকি বহিষ্কার। এসব বিবৃতির পর ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাসহ (ওআইসি) মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি বিজেপির আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। এতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা করার জন্য জরুরি ভিত্তিকে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই শেষ সমালোচনাটি বিশেষভাবে তীব্র।
এসব ঘটনা মোদি সরকারের জন্য অবশ্যই উদ্বেগের কারণ হবে। তথাকথিত ‘থিঙ্ক ওয়েস্ট’ নীতির আলোকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি ইরানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেছে এবং ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে ভারত। ২০১৫ সালে ৩৪ বছরের মধ্যে প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি আমিরাত সফর করেন। এরপর তিনি ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আবার সফর করেন। তার শেষ সফরের সময় তিনি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার স্বীকৃতি হিসেবে আমিরাতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান অর্ডার অব জায়েদে ভূষিত হন। মোদি সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও ইরানও সফর করেন। এই সময়ে ওইসব দেশ থেকেও ফিরতি সফর হয়।
মোদির আমলে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করাটা কেবল প্রতীকী ও গলাবাজীর মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না। বরং বড় বড় চুক্তি ও গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সুবিধাও অর্জিত হয়। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত হয় যথাক্রমে ভারতের চতুর্থ ও তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। এই দুটি দেশ ভারতের তেল আমদানির বৃহত্তম উৎসেও পরিণত হয়। গত ৫ বছরে জ্বালানি ও শিল্প খাতে অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য এই দুই দেশ মোট ১৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে প্রতিশ্রুতি দেয়। ভারত ও উপসাগরীয় এলাকার মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ওই অঞ্চলে বাস করা বিপুলসংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের। সৌদি আরবে প্রায় ২০ লাখ এবং আমিরাতে প্রায় ৩০ লাখ ভারতীয় বাস করে। তারা প্রতি বছর এই দুটি দেশ থেকে যথাক্রমে ১১.২ বিলিয়ন ডলার ও ১৩.৮ বিলিয়ন ডলার পাঠায়।
গত কয়েক বছরের কূটনৈতিক প্রয়াসের ফলে ভারত উপসাগরীয় দেশগুলোতে পাকিস্তানের ঐতিহ্যগত শক্তিশালী প্রভাব ম্লান করে দিয়েছে। সৌদি আরব ও আমিরাত কার্যকরভাবে ভারত ও পাকিস্তানের হাইফেন তুলে নিয়েছে এবং তারা দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের সাথে সম্পর্ককে আর জিরো-সাম গেম হিসেবে দেখে না। উপসাগরীয় দেশগুলো পাকিস্তানের সাথে তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে চললেও তারা ভারতে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেয়। এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। কারণ উভয় দেশই কাশ্মিরের ব্যাপারে ভারতকে মৌখিকভাবে নিন্দা করার ভাষা নমনীয় করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৯ সালের আগস্টে ভারতে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করে সৌদি আরব। এটি হয় ভারতের কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার মাত্র এক সপ্তাহ পর। এর মাধ্যমে সৌদি আরব দৃশ্যত এই ইঙ্গিত দিলো যে ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সে আর কাশ্মিরকে বাধা হিসেবে থাকতে দিতে চায় না। একইভাবে ভারতের কাশ্মির সিদ্ধান্তকে ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয় হিসেবে অভিহিত করেছে আমিরাত। এই পরিভাষাটি ভারতের খুবই পছন্দের।
উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছাকাছি হওয়ার মোদি সরকারের সক্রিয় কূটনৈতিক প্রয়াস এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সুযোগের ব্যাপারে স্বীকৃতি অতি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত ভারতের বৈষম্যমূলক নতুন নাগরিকত্ব আইন এবং সেইসাথে ২০১৯ সালের মে মাস থেকে মোদির পুনর্নির্বাচনের পর থেকে মুসলিমবিরোধী সহিংসতার বিরুদ্ধে সমালোচনা থেকে ভারতকে রক্ষা করেছে। কিন্তু ভারতে করোনাভাইরাস বিস্তারের জন্য মুসলিমদের দায়ী করাটা সম্ভবত মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এটা এই অঞ্চলে তার সম্পর্ককে ম্লান করে দিতে পারে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে উপসাগরভিত্তিক ভারতীয় নাগরিকেরা যদি ইসলামফোবিক কথাবার্তা বলতে থাকে, তবে মুসলিমদের প্রতি ভারতের আচরণ আর দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
আমিরাতের কসিমিসহ প্রখ্যাত আরব বিশ্লেষকদের সমালোচনার ফলে ভারতকে ড্যামেজ কন্ট্রোল অভিযান শুরু করতে বাধ্য করেছে। ১৯ এপ্রিল এক টুইটে মোদি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক, উভয় শ্রোতাদের লক্ষ্য করেই দেয়। মোদি বলেন, করোনাভাইরাস বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, বিশ্বাস, ভাষা বা সীমান্ত দেখে না। অনলাইনে উপসাগরীয় দেশগুলোতে থাকা ভারতীয়দের বিদ্বেষমূলক প্রচারণার প্রতিক্রিয়ায় আমিরাতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নজিরবিহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করে বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। অন্যান্য দূতাবাসকেও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আমিরাত, কাতার, ওমান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে কথা বলে জানিয়েছেন যে রমজান মাসে ভারত মুসলিমদেরকে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখবে এবং মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সব ধরনের চিকিৎসা সহায়তা দেবে।
মনে হচ্ছে, বর্তমানে ভারতের জরুরি কূটনীতি কাজে লেগেছে। বেশির ভাগ উপসাগরীয় দেশই উল্লেখ ভারতের প্রতিক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, যে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সূচনা করা হয়েছে ভারত কি তা বন্ধ করতে পারবে? যদি না পারে, তবে উপসাগরীয় দেশ ও সৌদি আরবের সাথে অনেক সতর্কভাবে প্রণীত সম্পর্ক নস্যাৎ হয়ে যাবে।