আফগানিস্তানের অন্তহীন যুদ্ধের ইতি টানতে পাকিস্তান ফ্যাক্টর
আফগানিস্তানের জটিল ইতিহাস আর রাজনীতির কথা বিবচেনা করে বলা যায় সেখানকার অন্তহীন যুদ্ধ শেষ হলে হয়তো তাদেরকে একটা অন্তহীন শান্তি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়তে হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও মার্চ মাসে আফগানিস্তান সফর করেন। কাবুলকে দেয়া সহায়তা কাটছাটের হুমকি দেয়ার পর তিনি দোহাতে গিয়ে তালেবানদের সাথে বৈঠক করেন। এর পরপরই তালেবানদের সাথে বৈঠক করেন আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল স্কট মিলার, এবং বিশেষ দূত জালমাই খলিলজাদ। দোহা থেকে দুজনই পরে ইসলামাবাদ যান পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার জন্য। আর অতি সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন।
দোহা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর খুবই দ্রুত এই বিরামহীন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, যেটা শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য কোন শুভ লক্ষণ নয়। এই অনিশ্চয়তার সাথে যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস – যার প্রভাব এখনও অজানাই রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার দ্রুততর হতে পারে, যেটা শান্তি চুক্তির বাস্তবায়নের উপর প্রভাব ফেলবে।
মৌলিক উত্তেজনা
আফগানদেরকে তাদের নিজেদের উপর ছেড়ে দিলে তারা কি শান্তি আনতে পারবে? দোহা চুক্তির পরের ঘটনাপ্রবাহ তেমন আশাপ্রদ নয়, আবার এখানে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এবং আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বা আন্তঃঅভ্যন্তরীণ সংলাপের শর্তাদি, কাবুলের আলোচক টিম গঠন, বন্দী বিনিময়, বা সহিংসতা বৃদ্ধি – এই সবকিছুই আফগানিস্তানের গভীরে প্রোথিত উত্তেজনার লক্ষণ মাত্র।
আফগানিস্তানের বিভিন্ন উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি মৌলিক ইস্যু: ক্ষমতা কাঠামো এবং বণ্টন, জাতিগত ভারসাম্য, এবং নিয়ন্ত্রণ ও আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ। অনেকগুলো গুরুতর বাধা রয়েছে তাদের – জাতিগত, উপজাতিগত, আঞ্চলিক, গোষ্ঠিগত, এবং আদর্শিক – সেই সাথে রয়েছে শহর/গ্রামের ভেদ। আফগানিস্তান একই সাথে প্রতিযোগিতামূলক ভূরাজনীতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক রাজনীতির মাঝখানে পড়ে গেছে। তাদের অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত-প্রবণ পরিস্থিতি – যেটা কারণে একটা অন্তহীন ক্ষমতার লড়াই চলছে, সেটার সাথে বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপের ঝুঁকি মিলিয়ে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা শুধু বেড়েই গেছে।
পাকিস্তানের সাথে তালেবান সিনিয়র নেতাদের যোগাযোগ থাকার কারণে আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের উপর তাদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে তালেবান-পাকিস্তান বোঝাপড়া নিয়ে বলা হয়েছে: “তালেবান আলোচক দলের সদস্যরা বার বার দোহা থেকে পাকিস্তানে অবস্থানরত গ্রুপের নেতা ও কমাণ্ডারদের সাথে আলোচনা করতে যান, যেখানে তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়া হয়েছে”।
মার্কিন তালেবান চুক্তি স্বাক্ষরের আগ দিয়ে প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক টাইমসের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়: “তালেবান ডেপুটি মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার – যিনি আলোচনায় নেতৃত্ব দেন – তিনি পাকিস্তান সফরে গিয়ে বেশ কিছু বড় ধরনের বৈঠক করেন, যেখানে প্রায় ৩০০ সিনিয়র ও মাঝারি পর্যায়ে কমাণ্ডার উপস্থিত ছিলেন”।
সংলাপের ভেতরে সংলাপ
বাস্তবতা হলো আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে হলে বেশ কিছু সঙ্ঘাতের মীমাংসা করতে হবে, এবং তথা-কথিত আন্তঃআফগান সংলাপের সাথে সাথে আরও কিছু সংলাপের প্রয়োজন হবে।
প্রথমত, কাবুলের পক্ষ থেকে প্রধান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সাথে সংলাপ চালাতে হবে। এই সংলাপেই জাতিগত ভারসাম্য, ক্ষমতা ভাগাভাগি, সংবিধান, তালেবানদের সাথে আলোচনার ব্রিফিং ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হবে। এই সবগুলোই বিতর্কিত ইস্যু। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, এবং ব্যক্তিরা বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বেশ কিছু শান্তি প্রস্তাব এরই মধ্যে দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা সংলাপ প্রয়োজন যেখানে দুই দেশের সম্পর্কের মৌলিক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। জালমাই খলিলজাদ একবার এই পাক-আফগান সম্পর্কের ‘সব সম্পর্কের মা’ হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন।
তৃতীয়ত, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে আলোচনা, যাদের নিজেদের শত্রুতা ও প্রতিযোগিতা প্রকাশের একটা ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান এবং এটা শান্তির প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। তাছাড়া মার্কিন-আফগান সংলাপের বিষয়টি তো রয়েছেই, যেখানে ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। বিশেষ করে তাদের আর্থিক সহায়তার প্রকৃতি কেমন হবে, কারণ এটা আফগান ন্যাশনাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এএনএসএফ) ভবিষ্যৎ এবং সেই সূত্রে শান্তি প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব ফেলবে।
সবশেষে, আন্তঃঅভ্যন্তরীণ আলোচনায় মধ্যস্থতা করবে কে? সেখানে কি শান্তিরক্ষী বাহিনী থাকবে? এই সংলাপের সংশ্লিষ্ট আলোচনার জন্য আঞ্চলিক দেশগুলোর ফোরাম কোনটি হবে? এবং কারা কারা এর অংশ হবে?
পাকিস্তান কিভাবে সাহায্য করতে পারে?
পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে সব বিবৃতি দিয়েছেন, যেখানে তারা ‘আফগান-নেতৃত্বাধীন, আফগান কতৃত্বাধীন’ শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন দেয়ার কথা বলেছেন, সেটা গণযোগাযোগের চর্চা হিসেবে ভালো। কিন্তু সরকারী নীতি হিসেবে এটা যথেষ্ট নয়। আফগান সরকার এখন বিভক্ত এবং শান্তি প্রক্রিয়ার কর্তৃত্ব নেয়ার পক্ষে যথেষ্ট দুর্বল। যেহেতু তারা এখন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি আগ্রাসী ও সমঝোতাবিমুখ তালেবানদের মুখোমুখি হয়েছে, তাই পাকিস্তানের সাহায্য তাদের প্রয়োজন। কিন্তু পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের যে সীমা, তার বাইরে গিয়ে পাকিস্তান এই সাহায্যটা দেবে বলে মনে হয় না।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের একটা দ্বন্দ্বসঙ্কুল ইতিহাস এবং একটা বিতর্কিত সীমান্ত রয়েছে। প্রত্যেকেই একে অন্যের শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করেছে। আফগানিস্তানের বহু সমস্যার কারণ হলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের সীমানা দখলের অভিযোগ এবং ভারতের কথিত সহায়তা নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপের চেষ্টা। আর পাকিস্তানের বহু সমস্যার কারণ হলো আফগানিস্তানের চ্যালেঞ্জ মেটানোর জন্য তাদের দুর্বল নীতি। আফগানিস্তানের আচরণ নিয়ে তাই পাকিস্তানের যৌক্তিক উদ্বেগ রয়েছে। আবার আফগান সরকারও বোধগম্যভাবেই তাদের ‘তালেবান’ সমস্যার জন্য পাকিস্তানকে দুষে থাকে।
তালেবান উচ্চাকাক্ষাকে কি পাকিস্তান ঠেকাতে পারবে?
নব্বইয়ের দশকে তালেবানদের সামনে মাঠ ছিল উন্মুক্ত। কিন্তু এবার দেশের মধ্যে বিরোধিতা হবে আরও বেশি। লড়াইয়ের জন্য কিছু একটা সামনে রয়েছে আফগানদের। শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটেছে, নারীদের অধিকারের উন্নতি হয়েছে, মিডিয়া পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, এবং মানুষ গণতন্ত্রের কিছুটা নমুনা দেখেছে – তা সেটার অবস্থা এই মুহূর্তে যেমনই হোক না কেন। এএনএসএফ প্রতিহত করার চেষ্টা করবে, কিন্তু তারা যদি ভেঙ্গে পড়ে, তাহলে বাহিনীর অবশিষ্টাংশ যুদ্ধটা জারি রাখার জন্য সিআইএর-অর্থায়নে গঠিত আঞ্চলিক মিলিশিয়া দলগুলোতে যোগ দেবে।
পাকিস্তানের কৌশলের মধ্যে তালেবানদের সাথে বিনিময়ের সুচিন্তিত শর্তগুলো থাকতে হবে। নিরপেক্ষতা এখানে কোন উপায় নয়। পাকিস্তানের নিরপেক্ষতা তালেবানদের জন্য ইতিবাচক। এটা তাদেরকে সংলাপে এবং আলোচনা ব্যার্থ হলে সঙ্ঘাতে একটা সুবিধা দেবে। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দীর্ঘ সশস্ত্র সঙ্ঘাত সীমিত করা এবং এ জন্য সকল পক্ষকে বিশেষ করে তালেবানদেরকে একটা সমঝোতার ব্যাপারে রাজি করানো। এর বিকল্পটা হবে ভয়ানক।