হাফতারের শাসক ঘোষণা এবং এরদোগানের পরিকল্পনা

0

জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক সমাধান প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতার নিজেকে লিবিয়ার শাসক ঘোষণা করেছেন। এক টিভি বক্তব্যের মাধ্যমে খলিফা হাফতার ২০১৫ সালে মরক্কোর স্কিরাটে স্বাক্ষরিত জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় হওয়া লিবিয়ার রাজনৈতিক চুক্তিটিকে অবৈধ ঘোষণা করে নিজেকে শাসক ঘোষণা করেছেন।

হাফতারের এই পদক্ষেপের মাধ্যমে লিবিয়ার পরিস্থিতি নতুন এক সঙ্কট পর্বে প্রবেশ করল। তার এই ঘোষণাকে যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি রাশিয়া ফ্রান্স অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেউই সমর্থন করেনি। তবে দেশগুলোর প্রতিক্রিয়ায় মাত্রাগত বেশ পার্থক্য রয়েছে।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত সরকার এবং আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা উপেক্ষা করে একতরফাভাবে নিজেকে লিবিয়ার শাসক হিসেবে ঘোষণায় খলিফা হাফতারের পদক্ষেপে আবারো প্রকাশ পেয়েছে যে, তিনি দেশটিতে সামরিক একনায়কতন্ত্র সৃষ্টি করার লক্ষ্য রেখে এগোচ্ছিলেন। তিনি চান না, লিবিয়ার সঙ্কটের সমাধান রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে হোক। লিবিয়ায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে হামলা চালিয়ে হাফতার মানবিক পরিস্থিতি আরো গভীর করেছিলেন। তিনি কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালে তেল উৎপাদন, পানি সরবরাহ এমনকি লিবিয়ার জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরবরাহে বাধা দিয়েছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে যে, তুরস্ক লিবিয়ার জাতিসঙ্ঘ-স্বীকৃত জাতীয় চুক্তির সরকার (জিএনএ) এবং অন্য সব বৈধ লিবীয় প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে।

লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফয়েজ আল-সররাজ বলেন, হাফতারের একতরফাভাবে নিজেকে লিবিয়ার শাসক ঘোষণায় আবারো প্রকাশ পেয়েছে যে, যুদ্ধবাজের অভ্যুত্থান প্রকল্প অবশ্যই শেষ করতে হবে। হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস স্পিকার হামাউদা সাইয়ালার অধীনে সংসদ অধিবেশনে বলা হয়, ‘আমরা আমাদের সব নাগরিককে আমাদের দেশকে আরো একবার স্বৈরশাসকের হাতে পড়া রোধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং আমাদের ঐক্য রক্ষার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’ সভার পর একটি লিখিত বিবৃতিতে জোর দেয়া হয়েছে যে, সংসদ দেশের ঐক্য রক্ষার লক্ষ্যে সব শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্যোগে সমর্থন দেবে।

এ মাসের গোড়ার দিকে জেএনএ বাহিনী ত্রিপোলির পশ্চিমে কৌশলগত শহরগুলো দখল করার পরেই মূলত হাফতারের এই ঘোষণা আসে। হাফতারের ঘোষণায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নানা ধরনের সমালোচনা আসে। হাফতারের একতরফা ঘোষণা অগ্রহণযোগ্য এবং এটি কখনোই দেশের পক্ষে টেকসই সমাধানের ব্যবস্থা করবে না বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদেশনীতির একজন মুখপাত্র মন্তব্য করেছেন। লিবিয়ায় মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে যে, দেশটির রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করার জন্য হাফতারের একতরফা প্রস্তাব ‘হতাশাজনক’ এবং দেশটির পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে ‘গুরুত্বপূর্ণ সংলাপে’ বসতে হবে সবাইকে। মস্কো মঙ্গলবার ঘোষণা করেছে যে, ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারের এলএনএ’র সাথে আর আলোচনায় না বসা এবং খলিফা হাফতারের নিজেকে একতরফাভাবে শাসক ঘোষণা- দুটোরই বিরোধিতা করে রাশিয়া। ফ্রান্স, হাফতারের নাম না নিয়েই বলেছে যে, লিবিয়ার দ্বন্দ্ব একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সমাধান করা যাবে না কেবল হবে জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সংলাপের মাধ্যমে।
লিবিয়ার নতুন পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, দেশটির অবস্থাকে নতুন এক সিদ্ধান্তকারী দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হাফতারের ত্রিপোলি দখল করে পুরো দেশের ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রকল্প সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহকে কার্যত ব্যর্থ করেছে। ফলে হাফতার দেশটিকে বিভক্ত করে পূর্বাঞ্চলের ওপর নিজের শাসন প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বিকল্প বেছে নিচ্ছেন বলে মনে হয়।

অন্য দিকে জিএনএ পাল্টা অভিযানে রমজানের মধ্যেই খলিফা হাফতারের সেনাবাহিনীকে দেশটির পশ্চিমাঞ্চল থেকে পুরোপুরি বিতাড়িত করতে চায় বলে মনে হচ্ছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থিত জেনারেল খলিফা হাফতার সম্প্রতি নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছিলেন ত্রিপোলিতে। বরাবরের মতো তিনি আবার নাগরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছিলেন। অথচ তিনি আগে ঘোষণা করেছিলেন, বার্লিন চুক্তির মাধ্যমে সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি মেনে চলবেন। শেষ পর্যন্ত তার সেই চুক্তি লঙ্ঘনের একমাত্র কারণ হতে পারে, বিশ্ব এবং তুরস্ক বিশেষভাবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে লিবিয়াকে নিজের হাতে নিতে বাধা দেয়ার মতো আর কেউ সেভাবে থাকবে না।

বাস্তবতা সে রকম হয়নি। জিএনএ বাহিনীর অবিশ্বাস্য প্রতিরোধ ও পাল্টা লড়াইয়ে এ সত্যটি উপলব্ধি করতে বাধ্য হন যে তিনি ভুল হিসাব করেছিলেন। তুরস্ক লিবিয়ার আন্তর্জাতিক-স্বীকৃত সরকারের সাথে সব ধরনের সহযোগিতা বজায় রেখেছে। লিবিয়ার সরকারি জিএনএ বাহিনী হাফতারের হামলাগুলোকে ব্যর্থ করে পাল্টা আক্রমণে তৎপর হয়ে পশ্চিম ত্রিপোলির সাবরাথা, সুরমান ও আল-আজাইলাত ছাড়াও মোট সাতটি শহর দখল করে নেয় এবং প্রতিবেশী তিউনিসিয়ার সীমান্তগুলোতে আবার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। জিএনএ বাহিনী এখন রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে তারধুনার দিকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে।

তারধুনা পশ্চিম লিবিয়ার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি, যেখান থেকে হাফতার ত্রিপোলি এবং লিবিয়ার অন্যান্য অংশে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অভিযান পরিচালনা করে আসছিলেন। এ ঘাঁটিটি বর্তমানে জিএনএ বাহিনী চার দিকে ঘিরে রেখেছে। তারধুনা ঘাঁটির পতন হলে পশ্চিমে হাফতারের সব সমর্থন কাঠামো ধসে পড়বে। জিএনএ বাহিনী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, তারধুনা দখল যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে। এরপর জিএনএ’র লক্ষ্য হতে পারে- দক্ষিণে আল-জুফরা এবং তারপরে পূর্বের আজদাবিয়ায়, সেখানে রয়েছে হাফতারের আসল নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল।
লিবিয়ার রাজ্য হাই কাউন্সিলের সভাপতি খালেদ আল মিসরি বলেছিলেন যে, জিএনএ রমজানের শেষে হাফতার বাহিনীকে পুরোপুরি নির্মূল করার পরিকল্পনা করছে। এই ক্ষেত্রে, লিবিয়া এখন এমন একটি সময়ে প্রবেশ করেছে যেখানে হাফতারের বিপর্যয় দৃশ্যমান। প্রশ্ন হলো ঠিক এই মুহূর্তে, হাফতার কেন নিজেকে শাসক ঘোষণা করতে গেলেন? তব্রুকের লিবিয়ার হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস-এর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানকারী হাফতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহায়তায় নিজের বৈধতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন যে সমগ্র লিবীয় জাতি তার কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয়।

এ পদক্ষেপটি অবাক করার কারণ হলো কেউ যখন স্থিরভাবে এবং সব কিছু হারাতে যাওয়ার পথে ক্রমাগত পরাজয়ের মুখোমুখি হন তখন তার পক্ষে এ ধরনের ঘোষণা দেয়া স্বাভাবিক নয়। এই পদক্ষেপটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ইউরোপ এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এটি স্পষ্ট করে যে, হাফতার তার পেশিশক্তি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও ফ্রান্সের সহায়তায় এখন অবধি দখল চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তিনি দেশকে বিভক্ত করতে পারলে পূর্ব লিবিয়ায় তার রাজত্ব চালিয়ে যাওয়ার সুযোগটি ধরে রাখতে সক্ষম হতে পারেন। এখন সেই চেষ্টাই তিনি করছেন। তাকে সমর্থনকারী বাহিনী, মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতের শুরু থেকেই এ জাতীয় পরিকল্পনা ছিল।

লিবিয়াকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত কতটা সফল হবে সেটি নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো কতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তার ওপর। ২০১১ সালে মোয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে লিবিয়ায় দু’টি শক্তির উদ্ভব ঘটে। মূলত রাশিয়া, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত পূর্ব লিবিয়ার সেনা কমান্ডার হাফতার এবং ত্রিপোলিতে জিএনএ, যা ইউএনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। শোষোক্ত সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক এবং কিছুটা ইতালি। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন একসময় হাফতারের প্রতি রয়েছে বলে মনে হলেও এখন আমেরিকা রাজনৈতিক সমঝোতা প্রত্যাশা করে বলে মনে হয়। রাশিয়া ঘোষণা দিয়ে পক্ষ না নিলেও ভাড়াটিয়া বাহিনী দিয়ে এবং পরোক্ষভাবে নানা ধরনের সাহায্য দিয়ে এসেছে হাফতারকে। ফ্রান্সের ভূমিকাও অনেকটা একই রকম।

এ অবস্থায় হাফতারকে লিবিয়ার একটি অংশের শাসক হিসেবে টিকে থাকতে হলে মিসর, আমিরাত বা সৌদি আরবের বাইরে রাশিয়া ও ফ্রান্সের মতো শক্তির প্রত্যক্ষ সমর্থন প্রয়োজন হবে। রাশিয়া সরাসরি লিবিয়ায় চলে এলে যুক্তরাষ্ট্র আবারো এখানে সক্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি হলে আমিরাত এবং সৌদি আরবের জন্য কূটনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। মিসরের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ইসরাইল জেনারেল হাফতারকে যে সহায়তা দিচ্ছে সেটিও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

এ অবস্থায় লিবিয়াকে অবিভক্ত রেখে আন্তÍর্জাতিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি শাসন বজায় রাখার প্রচেষ্টা সামনে আসতে পারে। এ ধরনের একটি প্রক্রিয়ার জন্যও হাফতারের পেশিশক্তির পরাজয়ের প্রয়োজন রয়েছে। সেই পরাজয় আসন্ন বলে মনে হচ্ছে।

অবশ্য করোনা-উত্তর পৃথিবীতে নতুন ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণের একটি সম্ভাবনাও সামনে চলে এসেছে। লিবিয়াসহ সার্বিক পরিস্থিতির ওপর তারও একটি প্রভাব দৃশ্যমান হতে পারে। লিবিয়ার পাশাপাশি আমিরাত ইয়েমেনের দক্ষিণেও একই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ঘটে যাওয়া সব মানবিক সঙ্কটের বিষয় উপেক্ষা করে বিনা পার্লামেন্টে ইয়েমেনকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে চালানো হচ্ছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com