ভারতে হিন্দু উগ্রবাদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক রিপোর্টে আঁতে ঘা লেগেছে দিল্লীর

0

ইউএস কমিশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের (ইউএসসিআইআরএফ) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে ভারতে হিন্দু উগ্রবাদের উত্থানের কথা বলা হয়েছে, যেখানে দেশটির মুসলিমদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে। 

স্বাভাবিকভাবেই এই পর্যবেক্ষণে ভারত সরকারের আঁতে ঘা লেগেছে যারা এখন হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী এবং যে কোন সমালোচনার ব্যাপারে তাদের অনীহা রয়েছে, সেটা যদি জোরালো প্রমাণের ভিত্তিতে হয়, তবুও। 

ইউএসসিআইআরএফের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রিবাস্তব অহংকারের সাথে বলেছেন: “ইউএসসিআইএরএফের বার্ষিক প্রতিবেদনে ভারতের ব্যাপারে পর্যবেক্ষণকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। ভারতের বিরুদ্ধে তাদের পক্ষপাতদুষ্ট এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ মন্তব্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার, তাদের মিথ্যা বিবরণ অন্য মাত্রায় চলে গেছে। নিজেদের কমিশনারদের তারা তাদের প্রচেষ্টার সাথে রাখতে পারেনি। এই সংগঠনকে বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে আমরা বিবেচনা করি এবং সেভাবেই আমরা এর সাথে ব্যবহার করবো”।

শ্রিবাস্তব ইউএসসিআইআরএফের দুজন কমিশনারের দিকে ইঙ্গিত করেন, এরা হলেন – গ্যারি এল. বাউয়ার এবং তেনজিন দর্জি। তারা তাদের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে বলেছেন যে, ভারতকে এই খারাপতম ঘটনাগুলো দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে না, কারণ এটা একটা প্রাণবন্তু গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে বিপরীত শক্তিও রয়েছে, যারা ধর্মীয় উগ্রবাদ রোধে সাহায্য করতে পারে। নিজেদের নির্লজ্জ অপকর্ম ঢাকা দেয়ার জন্যই নয়াদিল্লী তাদের উদাহরণ টেনেছে। 

ইউএসসিআইআরএফ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে বলেছে যাতে তারা ভারতসহ ১৪টি দেশকে ‘বিশেষ উদ্বেগজনক দেশ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। পাকিস্তানও যথারীতি এই তালিকায় রয়েছে। আফগানিস্তান রয়েছে ‘বিশেষ নজরদারি তালিকায়’ (এসডাব্লিউএল)। তবে, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ ও নেপাল কোন তালিকায় নেই, যদিও শ্রীলংকা ও নেপালে কিছু ঘটনার বিষয় সংক্ষেপে রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। 

ভারতের উপর প্রতিবেদন

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০১৯ সালে ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতার ‘ব্যাপক অবনতি হয়েছে’ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অব্যাহতভাবে হামলার শিকার হয়েছে। 

“মে মাসে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার তার পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে জাতীয় পর্যায়ে এমন নীতি গ্রহণ করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে সারা ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন করা হয়েছে, বিশেষ করে মুসলিমরা এর শিকার হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি এবং তাদের প্রার্থনার জায়গাগুলোর উপর কোন বাধা ছাড়াই হামলা ও সহিংসতা চলতে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, এবং ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানোর সাথে যুক্ত হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে সহিংসতা উসকে দেয়া হয়েছে”।

“উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট (সিএএ) প্রণয়ন করেছে, যেখানে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে যে সব অমুসলিম অভিবাসী ভারতে এসেছে এবং এখন ভারতে অবস্থান করছে, তাদেরকে দ্রুত ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সারা দেশে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স (এনআরসি) তৈরির প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ন্যাশনাল পপুলেশান রেজিস্টার (এনপিআর) তৈরির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী রাজ্যের অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করার জন্য এনআরসি বাস্তবায়ন করেছে। আগস্টে যখন রাজ্যের এনআরসি প্রকাশ করা হয়, সেখানে দেখা গেছে হিন্দু ও মুসলিমসহ ১.৯ মিলিয়ন অধিবাসী তালিকা থেকে বাদ পড়েছে”।

“যারা বাদ পড়েছে, তারা এর পরিণতি নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। জাতিসংঘের তিনজন বিশেষ দূত সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এনআরসি থেকে বাদ পড়ার ফলে অধিবাসীরা ‘রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়তে পারে, তাদেরকে ফেরত পাঠানো হতে পারে বা দীর্ঘসময় বন্দি রাখা হতে পারে”। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেও অভিবাসীদেরকে ‘উঁইপোকা’ আখ্যা দিয়ে তাদের নির্মূল করার কথা বলেছেন। আসামের এনআরসি থেকে হিন্দুরা বাদ পড়ায় তিনি এবং বিজেপির অন্যান্য কর্মকর্তারা সিএএ’র পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন যাতে হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য সংশোধনী ব্যবস্থা নেয়া যায়। সিএএ’র কারণে তালিকাভুক্ত অমুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা তাদের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করতে পারবে এবং বন্দীত্ব বা ফেরত যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে”।

“বিজেপি নেতারা দেশজুড়ে এনআরসির পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা করা হলে বহু মিলিয়ন মানুষের নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে পড়বে, কিন্তু সিএএ থাকার কারণে মুসলিমরা একাই শুধু অপমানিত হবে এবং রাষ্ট্রহীন হওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকির মুখে পড়বে। সিএএ’র বিরুদ্ধে ডিসেম্বরে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়, যেখানে পুলিশ এবং সরকারপন্থী গ্রুপগুলো বিক্ষোভকারীদের উপর সহিংসতা চালিয়েছে। উত্তর প্রদেশে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথ সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, তাদেরকে ‘গুলি খাওয়ানো উচিত, বিরিয়ানি নয়’। ডিসেম্বরে শুধুমাত্র উত্তর প্রদেশেই বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিক্ষোভকারীদের উপর হামলায় প্রায় ২৫ জন নিহত হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, পুলিশ বিশেষভাবে মুসলিমদেরকে টার্গেট করে অভিযান চালিয়েছে”।

“পুরো ২০১৯ সাল জুড়ে সরকারের সিএএ প্রণয়ন, গরু জবাই ও ধর্মান্তরিতকরণ আইন জোরদার করা, এবং নভেম্বরে বাবরি মসজিদের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের রুলিং – এগুলোর কারণে দেশজুড়ে একটা দায়মুক্তির সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হয়রানি ও সহিংসতা সৃষ্টিকারীরা বিচার ছাড়াই পার পেয়ে যাচ্ছে। আগস্টে সরকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসনও বাতিল করে এবং এমন সব বিধিনিষেধ আরোপ করে, যেগুলোর কারণে ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে”।

হত্যা

“গো জবাই করার দায়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা গরুর মাংস খাওয়ার কারণে মানুষ হত্যা অব্যাহত রয়েছে। এ ধরণের বেশির ভাগ হামলা হচ্ছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে। হামলাকারীরা সাধারণত উগ্র হিন্দুবাদী সুরে কথা বলছে। জুন মাসে ঝাড়খাণ্ডে কিছু জনতা তাবরেজ আনসারী নামের এক মুসলিমের উপর হামলা করে এবং তাকে ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বাধ্য করে এবং তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। গো জবাই বা ধর্মান্তরিতকরণের কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদেরকেই পুলিশ বেশির ভাগ সময় গ্রেফতার করে, হামলাকারীদেরকে নয়”।

“খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়ে গেছে। অন্তত ৩২৮টি সহিংস ঘটনার খবর জানা গেছে এবং তাদেরকে জোর করে ধর্মান্তরিতকরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ধরণের হামলাগুলো সাধারণত প্রার্থনার সময় হয়ে থাকে এবং এর পরিণতিতে বহু চার্চের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে বা সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে”।

“২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোকে বলে যাতে এ ধরণের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর আইন করা হয়। ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার এবং ১০টি রাজ্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারায় সুপ্রিম কোর্ট আবারও তাদেরকে এই নির্দেশনা দেয়। কিন্তু এই আদেশ না মেনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ বলেন যে, বিদ্যমান আইনও এ জন্য যথেষ্ট এবং হত্যাকাণ্ড বাড়ার বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন। এদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোকে নির্দেশ দিয়েছে যাতে ২০১৯ সালের অপরাধ রিপোর্ট থেকে এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে বাদ দেয়া হয়। 

“২০১৯ সালে বৈষম্যমূলক নীতি, উসকানিমূলক বক্তব্য, এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ব্যাপারে জাতীয়, রাজ্য ও স্থানীয় পর্যায়ে নিরবতা বেড়ে যাওয়ায় অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রিপোর্টিং পিরিয়ডের পরও ভারত এই নেতিবাচক পথে চলেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, দিল্লীতে তিন দিন ধরে সহিংসতা চলেছে এবং মুসলিমদের ঘরবাড়ির উপর হামলা করা হয়েছে। এমন সংবাদ জানা গেছে যে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত দিল্লী পুলিশ হামলা বন্ধ করে ব্যার্থ হয় এবং এমনকি সহিংসতায় অংশ নেয়। ওই হামলায় অন্তত ৫০ জন নিহত হয়”।

সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞার আহ্বান

রিপোর্টে মার্কিন সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে যাতে ধর্মীয় স্বাধীনতা চরমভাবে লঙ্ঘনের দায়ে তারা ভারত সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও কর্মকর্তাদের উপর সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বিশেষ ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের দায়ে যাতে এই সব ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করা হয় বা মানবাধিকার বিষয়ক আর্থিক ও ভিসা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া হয়। রিপোর্টে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতি আরও জোর দাবি জানানো হয়েছে যাতে ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতার অবস্থা নিয়ে শুনানি করা হয় এবং ভারতের ব্যাপারে মার্কিন নীতি পুনর্বিবেচনা করা হয়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com