আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব সীমিত করেছে মার্কিন-তালেবান চুক্তি
২০০১ সালের নভেম্বরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনে তালেবান সরকারের পতনের এক সপ্তাহ পর ভারতীয় কূটনীতিকদের ছোট্ট একটি প্রতিনিধি দলকে বহন করে একটি বিমান কাবুলের উত্তরে বাগরাম বিমান ঘাঁটিতে অবতরণ করে।
এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে নয়াদিল্লীর পুনপ্রবেশ ঘটে। পাঁচ বছর আগে ১৯৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তালেবানরা কাবুলের ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল ভারত।
মার্কিন-নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর সহায়তা নিয়ে আফগানিস্তানের নর্দার্ন অ্যালায়েন্স তালেবানদের পরাজিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ওই সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
২০০১ সালে কাবুল সফরকারী ভারতীয় প্রতিনিধি দলে ছিলেন আফগানিস্তানে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায়। তিনি বললেন, “আফগানিস্তানে আমরা যখন ফিরে যাই, তখন আমাদের মিশ্র একটা ধারণা ছিল”।
দিনব্যাপী ওই কূটনৈতিক সফরের উদ্দেশ্য ছিল আফগান রাজধানীতে দূতাবাস আবার চালু করা। এর মধ্য দিয়ে ভারতের জন্য আফগানিস্তানের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে।
জোরালো সম্পর্ক গড়ে তোলা
এর পর থেকেই ভারত পরবর্তী আফগান সরকারগুলোর সাথে জোরালো সম্পর্ক গড়ে তোলে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটিতে উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে তারা। ২০০১ সাল থেকে ভারত সেখানে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যে কোন একক দেশে নয়াদিল্লীর এটাই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
মুখোপাধ্যায় আল জাজিরাকে বললেন, “বিজয়ী নর্দার্ন অ্যালায়েন্স এবং তাদের সহযোগি ও সমর্থকদের কাছে আমরা ছিলাম মিত্র। কিন্তু সাধারণ আফগান – যারা পিডিপিএ’র (পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান) বিরোধিতা করতো – তাদের অনেকের মধ্যেই ভারতের ব্যাপারে আস্থার ঘাটতি ছিল, যেটা আমাদেরকে কাটিয়ে উঠতে হয়েছে”। বর্তমানে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ফেলো হিসেবে কাজ করছেন মুখোপাধ্যায়।
পিডিপিএ ছিল সোভিয়েত পন্থী এবং তাদের সরকারের আমলে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। যুক্তরাষ্ট্র সে সময় আফগান গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে এবং যোদ্ধা বা মুজাহিদিনদেরকে তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সাহায্য করে।
তিনি আরও বললেন, ভারতের ব্যাপারে অনাস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করছে তালেবানবিরোধী বাহিনীগুলোর প্রতি সহায়তা, মানবিক পদক্ষেপ, স্কলারশিপ, এবং ভারতীয় সংস্কৃতি – বিশেষ করে বলিউডের জনপ্রিয়তা।
তালেবানদের প্রত্যাবর্তন?
প্রায় ২০ বছর পরে ভারতের জন্য আবারও একটা বড় ধরনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে কারণ নয়াদিল্লী যাদেরকে ঘৃণা করে, সেই তালেবানরা আবার কাবুলের ক্ষমতার করিডোরে ফিরে আসছে বলে মনে হচ্ছে।
ভারত যদিও আফগানিস্তানে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে এবং সেখানে তাদের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে, এর পরও যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যকার শান্তি প্রক্রিয় থেকে ভারতকে দূরে সরিয়ে রেখা হয়। প্রায় দুই বছর আগে এই শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ২৯ ফেব্রুয়ারি শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে এটা একটা পরিণতিতে পৌঁছায়।
এখন যেহেতু মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে এবং আন্ত:আফগান আলোচনা শুরুর একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, এই অবস্থায় শান্তি পরবর্তী আফগান ভূরাজনীতিতে ভারতকে তাদের জায়গা খুঁজে নিতে হবে।
যারা ঘটনাবলীর উপর গভীরভাবে নজর রাখছে, তারা আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থ ও ভবিষ্যতের বিষয় নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশানের ফেলো কবির তানেজা বললেন, “নয়াদিল্লী আফগানিস্তানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন দিয়েছে, এবং প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিকে পেছনে তাদের সমর্থন রয়েছে”।
তিনি বলেন, “তবে, দুঃখজনক বিষয় হলো তালেবানদের সাথে আলোচনার মতো বিষয়গুলোতে নিজেদের মত প্রতিফলিত হওয়ার মতো সক্ষমতা ভারত গড়ে তুলতে পারেনি”।
বহু কিছু হারানোর শঙ্কা থেকে ভারত দর কষাকষির প্রক্রিয়ার উপর নজর রাখছে। মস্কোর আলোচনায় তারা অংশ নিয়েছিল এবং এমনকি কাতারের রাজধানী দোহাতে মার্কিন-তালেবান চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
কাবুলের সেন্টার ফর কনফ্লিক্ট অ্যাণ্ড পিস স্টাডিজের ডেপুটি ডিরেক্টর হেকমাতুল্লাহ আজামি বললেন, ভারতকে অবশ্যই তালেবানদের সাথে আলোচনা শুরু করতে হবে। তিনি বলেন, “এটাও দেখতে হবে যে, তালেবানরা তাদের সাথে আলোচনার জন্য রাজি আছে কি না”।
আজামি বলেন, “পাকিস্তান এবং গেরিলা গ্রুপগুলোর সাথে তালেবানদের সম্পর্ক আফগানিস্তানে ভারতের ভবিষ্যতের উপর বিরাট প্রভাব ফেলবে”। তিনি আরও বলেন যে, তালেবানরা নব্বইয়ের দশকে বিদেশী প্রভাব থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিল। ভারত সম্পর্কিত নীতির ব্যাপারে এখনও তারা পাকিস্তানের উপর নির্ভর করে আছে।
ভারতের সতর্ক কৌশল
নয়াদিল্লীর সতর্কতার কারণ হলো মার্কিন-তালেবান আলোচনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকা। তাদের এই ভূমিকার কারণে ভারতের উদ্বেগ হলো শান্তি-পরবর্তী আফগানিস্তানে তারা হয়তো বাদ পড়ে যাবে।
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক মুখোপাধ্যায় বলেন, “আফগানিস্তানে ভারতের বিনিয়োগগুলো হলো সাধারণ আফগানদের জন্য। পাকিস্তান অবশ্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যাতে এই বিনিয়োগের ক্ষতি করা যায় কিন্তু আফগানিস্তানের জনগণের সমর্থন ভারতের সাথে থাকবে”।
তবে, এই পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বোঝা যায় শান্তি চুক্তি পরবর্তী আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব সীমিত থাকবে এবং সেখানে তারা যে কাজ করেছে, সেগুলোও কম গুরুত্ব পাবে।
আজামি বলেন, “এমনকি সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতির কথা ভাবলেও এই সম্ভাবনা কম যে তালেবানরা ভারতের ব্যাপারে উদার হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতে সেনা ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ হয়তো তালেবানরা চাইবে না”।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন আফগানিস্তান থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে, এই অবস্থায় সেখানকার ভারতীয় প্রকল্পগুলোর উপর এর উত্তাপ পড়তে শুরু করেছে।
পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ তানেজা বললেন, “আফগানিস্তানে ভারতের যে সব তৎপরতা ছিল, উন্নয়ন সহায়তা, জনগণের পর্যায়ে যোগাযোগের কর্মসূচি, সেগুলোও পরিচালিত হতো যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্রদের নিরাপত্তার অধীনে। এখন তারা চলে যাওয়ার কারণে সেখানে নয়াদিল্লীর নীতিগুলো পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে”।
আন্ত:আফগান আলোচনার প্রক্রিয়া যখন এগিয়ে চলেছে, এ অবস্থায় ভারত একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করছে এবং এই আলোচনার ফলাফল ঠিক করে দেবে আফগানিস্তানে ভারতের অবস্থান কি হবে এবং সেই সূত্রে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান কোথায় থাকবে।
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক বললেন, তবে অনেক কিছুই নির্ভর করছে ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে তালেবানদের অবস্থান কোথায় থাকবে, তার উপর।
মুখোপাধ্যায় বলেন, “তালেবানরা যদি আগের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে, তাহলে আমাদেরকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হবে। কিন্তু আন্ত:আফগান আলোচনার মাধ্যমে তারা আসে, তাহলে হয়তো একটা পথ খোলা থাকতে পারে”।