গার্মেন্টসে ছাঁটাই আতঙ্ক
করোনাভাইরাসের প্রভাবে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে ছাঁটাই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কারণ গার্মেন্টসে অর্ডার বাতিল বা স্থগিত করছে বায়াররা। এ অবস্থায় কারখানায় কাজ না থাকলে এমনিতেই বেতন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত অধিকাংশ শ্রমিক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে
শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো অবস্থায় এখনো যায়নি। তবে করোনাভাইরাস দেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডায় ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব দেশের অনেক শহর এখন ‘লকডাউন’। বাংলাদেশেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ মরতে শুরু করেছে। এ অবস্থা শিগগিরই স্বাভাবিক না হলে কর্মী ছাঁটাই হবেই। শ্রমিক নেতারা বলছেন, সরকারের উচিত গার্মেন্টস খাতের লাখ লাখ শ্রমিকের জন্য আপৎকালীন তহবিল গঠন করা।
তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বুধবার পর্যন্ত ৯৪ কারখানা ১০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ হারিয়েছে। এ অবস্থা সবগুলো কারখানারই। এ অবস্থায় বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে একটি ওয়েব পোর্টাল খোলা হয়েছে। যেখানে লগিং করে মালিকদের অর্ডার বাতিল বা স্থগিতাদেশের বিষয়ে তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মালিকদেরকে এ-সংক্রান্ত চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এই তথ্য পাওয়ার পর নির্ধারণ করা হবে সরকারের কাছে গার্মেন্টস মালিকরা কী কী নীতি-সহায়তা চাইবে। যদিও এ বিষয়ে বিজিএমইএ নেতারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে না পারলে সরকারও সহায়তার হাত বাড়াতে চাইবে না। এজন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক মিটিংয়ে আছেন বলে জানান তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা।
সার্বিক পরিস্থিতিতে পোশাক শ্রমিকরা চাকরিচ্যুত হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন। মিরপুরের কালশীর আলেমা বেগম নামে এক নারী কর্মী জানান, ‘যে অবস্থা শুনছি, তাতে যেকোনো সময় কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কাজ বন্ধ হলে মালিকরা তো বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবেন না। কারণ তারা কাজ করিয়েই তো আমাদের বেতন দেন। তিনি বলেন, তারপরও আল্লাহ আল্লাহ করছি, সবকিছু তার হাতে।’ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) গত বুধবার জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট প্রবল হতে পারে। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার যদি সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা না নেয়, তবে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ তাদের চাকরি হারাবেন। এ হিসাবে করোনাভাইরাসের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই গত এক বছরে দেড়শোর বেশি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য কারখানা রয়েছে ৭০টি। এর মানে গার্মেন্টস খাতে এমনিতেই চাকরি হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। এখন করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা করছি। কারণ, এর কারণে কমপ্লায়েন্ট কারখানার অর্ডার বাতিল বা স্থগিত হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এই সময়টা হলো গার্মেন্টস খাতের বায়ারদের অর্ডার পাওয়ার সময়। অর্ডার তো পাচ্ছেই না, বরং অনেকের অর্ডার বাতিল বা স্থগিত হচ্ছে। একটি গার্মেন্টস কারখানার মালিক জানিয়েছেন, এ বছর রেকর্ড পরিমাণ অর্ডার তিনি পেয়েছিলেন কিন্তু পরে কাজ বন্ধ রাখার কথা বলেছে বায়াররা। এ অবস্থায় যদি কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকে, তাহলে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে না কোনো মালিক। ছাঁটাই বা বেতন বন্ধ করতেই হবে তাকে। এক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এজন্য সরাসরি শ্রমিকদের জন্য আপৎকালীন তহবিল গঠন করার দাবি জানাই।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, করোনার প্রভাব সারা বিশে^ই পড়েছে। বাংলাদেশও অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, এর আগে বৈশি^ক মন্দার সময়ও প্রচুর মানুষ বেকার হয়েছিল। করোনাভাইরাসের যে অবস্থা চলছে, তাতে এবারও হয়তো অনেককে চাকরিহারা হতে হবে। তবে সরকার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, এখন আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হলো এবং সরকারের পরিকল্পনা হলো মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। এটা যাতে আর বিস্তার না হয়। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হবে সর্বনিম্ন ক্ষতির বিষয়ে। সার্বিক অবস্থা দেখে পরবর্তিতে কী করণীয় হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, গার্মেন্টস খাতে এখনো ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে না। আপাতত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে বায়াররা যদি গণহারে অর্ডার বাতিল করে, তখন বাধ্য হয়েই কারখানার কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ওই সময় খ-কালীন সময়ের জন্য অনেকে বেকার হতে পারেন। তবে সব কিছু নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের কারণে পুরো খাতে কী ধরনের প্রভাপ পড়বে তার ওপর।
এমনিতেই গত কয়েক বছরে যে হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সে হারে কর্মসংস্থান বাড়েনি। করোনাভাইরাসের কারণে বেকারত্বের হার বাড়তে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এটা খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। তিনি বলেন, বেকারত্ব বাড়বে কি না সেটা সময়ই বলে দেবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর আমরা জরিপ করে দেখি, তখন বলা যাবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় কমেছে। অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি শেষে পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম। একই সময় রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও কমেছে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার বা ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এটি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ১ শতাংশের সমান।