পতন ঠেকাতে পুঁজিবাজারে অদ্ভুত সমাধান

0

করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি রুখতে এক ‘অদ্ভুত আদেশ’ জারি করেছে দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। সর্বশেষ পাঁচ কার্যদিবসের গড়মূল্য নিয়ে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে এসইসি। এতে লেনদেন ছাড়াই বেশিরভাগ সিকিউরিটিজের দর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের যে সর্বনিম্ন মূল্য (ফ্লোর প্রাইস) নির্ধারণ করা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সেগুলোর দর তার নিচে নামতে পারবে না। তবে সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ সীমা অনুযায়ী তা বাড়তে পারবে। সিকিউরিটিজ আইনের বিশেষ ক্ষমতাবলে এ আদেশ জারি করে এসইসি।

দেশে করোনাভাইরাসে রোগী শনাক্তের সংবাদের পর ১২ মার্চ থেকে টানা চার কার্যদিবসে বড় দরপতনের ঘটনা ঘটে। এতে মাত্র চার কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক প্রায় ১৫ শতাংশ কমে গিয়ে ৩৬০৩ পয়েন্টে নামে। সূচক ফিরে যায় সাত বছর আগের অবস্থানে। এমন পরিস্থিতিতে পতনরোধে করণীয়

নির্ধারণে গত বুধবার রাতে এসইসির চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠকে শেয়ারের সর্বনিম্ন দর নির্ধারণের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এদিকে এসইসির এমন নির্দেশনার সমালোচনা করেছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর এক পরিচালক ও একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। শেয়ারের সর্বনিম্ন দর বেঁধে দেওয়ার ফলে পুঁজিবাজারে ক্রেতাসংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। ক্রেতার সংখ্যা নিয়মিত কমতে থাকবে। স্থানীয়দের পাশাপাশি বিদেশিরাও শেয়ার বিক্রি করতে পারবে না। ফলে শেয়ার বিক্রির সুযোগ কমায় এ বাজারের প্রতি বিদেশিরা নিরুৎসাহিত হবেন।

এ বিষয়ে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় অনুষদ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মুসা বলেন, আমার জানামতে, এরকম কোনো অ্যাকশন পৃথিবীর কোথাও হয়নি। এটা একটি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে ১০ টাকার শেয়ার ১৪ টাকায় কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। এর ফলে কেউ তা কিনতে চাইবে না। এটা না করে বরং এসইসি অনির্দিষ্টকালের জন্য পুঁজিবাজার বন্ধ করে দিতে পারত, যেটা ইন্দোনেশিয়া করেছে। আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত এসইসিকে সেটাই করতে হবে।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, এসইসির এ নির্দেশনা বর্তমানে যে প্যানিক চলছিল, তা হয়তো একটু বিলম্বিত করবে। কিন্তু শেয়ার লেনদেন না করেই যেভাবে দর বাড়িয়ে দেখানো হলো, তাতে পুঁজিবাজার আরও ক্রেতাসংকটে পড়বে। গতকালের কার্যদিবসেই এর প্রতিফলন দেখা গেছে।

গতকাল ডিএসইতে আধঘণ্টার জন্য লেনদেন চালু হলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শেয়ারে কোনো ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তালিকাভুক্ত প্রায় সব শেয়ারে বিপুলসংখ্যক বিক্রেতা শেয়ার বিক্রির আদেশ দিলেও কেনার আগ্রহ দেখিয়েছেন হাতেগোনা কিছু বিনিয়োগকারী।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারের পতনরোধে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েও তা না করায় এসইসি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে পূর্ববর্তী পাঁচ কার্যদিবসের গড় মূল্যের ভিত্তিতে সিকিউরিটিজের সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত সোমবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বুধবার থেকে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে সহায়তার অংশ হিসেবে বিনিয়োগ শুরু করবে। তবে তারা সেই কথা রাখেননি। বুধবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মাত্র ১৩ কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে, মোট লেনদেনের মাত্র ৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে এসইসির কমিশনার প্রফেসর হেলাল উদ্দিন নিজামী বলেন, করোনা আতঙ্কে পুঁজিবাজারে সৃষ্ট টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছেন। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

এসইসির এ সিদ্ধান্তের ফলে গতকালের মাত্র আধঘণ্টার লেনদেনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রায় সব শেয়ারের দর বাড়ায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ বা ৩৭১ পয়েন্ট বেড়ে গেছে। পাঁচ কার্যদিবসের গড়মূল্য গতকালের প্রারম্ভিক মূল্য নির্ধারণ করায় বেশিরভাগ শেয়ারের দর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। মূলত একটি নির্দিষ্ট সীমার পর সূচকের যাতে পতন না হয়, সেজন্যই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে এসইসি সূত্রে জানা গেছে। বাস্তবে গতকাল লেনদেন হওয়া ৩৪২টি সিকিউরিটিজের মধ্যে ১৫২টির দরই অপরিবর্তিত ছিল। দর বাড়ে ১৪১টির। শেয়ারদর কমার সুযোগ না থাকলেও ৪৯টির দর কমেছে।

গতকাল এসইসি এক অফিস আদেশে জানায়, পুঁজিবাজার উন্নয়ন ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অ্যাক্ট, ১৯৯৩ এর ১৬ ধারা অনুযায়ী স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হওয়া শেয়ারমূল্য নিয়ন্ত্রণে এসইসি নির্দেশনা জারি করছে। সিকিউরিটিজ আইনের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে ১৯ মার্চের আগের সর্বশেষ পাঁচ কার্যদিবসের গড়মূল্য তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নির্ধারিত সর্বনিম্ন দরের নিচে কোনো সিকিউরিটিজের মূল্য নামতে পারবে না। তবে দরবৃদ্ধিতে প্রচলিত সার্কিট ব্রেকারের নির্ধারিত সীমা অপরিবর্তিত থাকবে।

ধরা যাক, ১৯ মার্চের আগের পাঁচ কার্যদিবসের গড় মূল্যের হিসাবে কোনো কোম্পানির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস (সর্বনিম্ন দর) ছিল ২০ টাকা। সার্কিট ব্রেকার ঊর্ধ্বসীমা অনুযায়ী শেয়ারটি সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়তে পারে। আগামী কয়েক দিনে শেয়ারটির দর বেড়ে ২৫ টাকায় উন্নীত হলো। এখন সার্কিট ব্রেকারের সর্বনিম্ন সীমা না থাকায় শেয়ারটির দর এক দিনে ২০ টাকায় নেমে আসতে পারবে। তবে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারিত থাকায় তা ২০ টাকার নিচে নামতে পারবে না।

শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণসংক্রান্ত এসইসির আদেশ নিয়েও নানা ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, প্রতিদিন লেনদেনের আগেই ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ হবে। আবার কেউ কেউ মনে করছেন সার্কিট ব্রেকারের শুধু সর্বোচ্চ সীমাই থাকবে, এতে শেয়ারদর বেড়ে চলবে। এ বিষয়ে এসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, ১৯ মার্চে সিকিউরিটিজগুলোর যে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছে, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত শেয়ারদর তার নিচে নামতে পারবে না। তবে সার্কিট ব্রেকারের উচ্চসীমা অনুযায়ী বাড়তে পারবে।

এদিকে শেয়ারের সর্বনিম্ন দর বেঁধে দেওয়া সংক্রান্ত আদেশ জারিতে বিলম্বের কারণে গতকাল ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ নির্ধারিত সময়ে লেনদেন চালু করতে পারেনি। নির্ধারিত সময় সকাল সাড়ে ১০টার পরিবর্তে দুপুর ২টায় লেনদেন শুরু হয়, যা মাত্র আধঘণ্টা চলে।

জানা যায়, ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ ও সার্কিট ব্রেকার সংক্রান্ত এসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজগুলোর প্রারম্ভিক মূল্য নির্ধারণ করতে দেরি হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে লেনদেন শুরু করতে পারেনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ। এজন্য সকাল সাড়ে ১০টার পরিবর্তে লেনদেন বেলা সাড়ে ১১টা শুরুর কথা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে বলা হলেও পরে তা দুপুর ১টায় চালু হবে বলে জানানো হয়। শেষ পর্যন্ত দুপুর ২টায় আধঘণ্টার জন্য লেনদেন চালু করে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ। তবে লেনদেন ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয়। এসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী, পূর্ববর্তী পাঁচ দিনের গড়মূল্যের হিসাবে সিকিউরিটিজের ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হলেও লেনদেন শেষে ৪৯টি সিকিউরিটিজের দর কমেছে বলে ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেখানো হয়। অথচ সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করায় কোনো শেয়ারের দর কমে যাওয়ার সুযোগ ছিল না।

এদিকে ডিএসই ত্রুটি-বিচ্যুতির মাধ্যমে সব সিকিউরিটিজের গড়মূল্য অনুযায়ী লেনদেন শুরু করলেও অন্য পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের পুরো লেনদেনেই নানা ধরনের অসংগতি দেখা গেছে। গতকাল সিএসই বেশিরভাগ সিকিউরিটিজের গড়মূল্য নির্ধারণ না করেই দুপুর ১টায় লেনদেন শুরু করে দেয়। লেনদেন চলাকালে ৮৫টি সিকিউরিটিজ হাতবদল হয়েছে। এর মধ্যে ৭১টি সিকিউরিটিজ গত পাঁচ কার্যদিবসের গড়মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই লেনদেন হয়েছে। ফলে ওইসব সিকিউরিটিজের লেনদেন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিএসই কর্র্তৃপক্ষ।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com