উচ্ছেদ বিলাসী বিল

0

সরকারি একটি প্লট প্রকল্পের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের নামে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের ওই জমি থেকে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদে প্রথম পাঁচ ধাপেই প্রায় ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল। ষষ্ঠ ও চূড়ান্ত ধাপে রহস্যজনকভাবে প্রস্তাবটি মাঠ পর্যায়ে ফেরত পাঠানো হয়। সে চিঠিতে প্রস্তাবকারী নির্বাহী প্রকৌশলী যেন দ্রুত সংস্থাটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে ‘কথা বলেন’ সে নির্দেশ দেওয়া হয়। তারপর ওই নির্বাহী প্রকৌশলীই আরেক চিঠিতে ওই খরচ প্রায় ১ কোটি টাকা দেখান।   

যেখানে প্রকল্পের ৬ হাজার ২৫০ জন শ্রমিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের একবেলা খাবার খরচ বাবদ দেখানো   ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৭৫০ টাকা। বলা হয়েছে, ৭০টি বুলডোজার ভাড়ায় লেগেছে ৫৪ লাখ ৫ হাজার ৪০০ টাকা, মাইকিং ও রিকশা ভাড়ায় লেগেছে ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। উচ্ছেদকাজে নিয়োজিত ২ হাজার ৭০০ শ্রমিকের মাথায় বাঁধার জন্য লাল ফিতা কিনতে লেগেছে ২০ হাজার টাকা। পুলিশ আনা-নেওয়ার কাজে ১২৫টি বাস লেগেছে, যার ভাড়া দিতে হয়েছে ১৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। শ্রমিক আনা-নেওয়ার জন্য ১০০ ট্রাক ভাড়ায় লেগেছে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ টাকা। দুর্ঘটনা আশঙ্কায় ১৫টি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা হয়েছিল, যে বাবদ খরচ হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৪০ টাকা। সব মিলিয়ে খরচ দেখানো হয় ৯৯ লাখ ১২ হাজার ৭৯০ টাকা।

উচ্ছেদ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজেদের দাপ্তরিক কাগজপত্রে ৫ দিনের উচ্ছেদ অভিযানের নাম দিয়ে প্রায় কোটি টাকা খরচের ফিরিস্তি দিয়ে বেশিরভাগ অর্থ জাতীয় গৃহায়ন কর্র্তৃপক্ষ (জাগৃক) থেকে তুলেও নেওয়া হয়েছে।

গত মাসের শেষ সপ্তাহে এসব অনিয়ম নিয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্তও শুরু করেছে জাগৃক। জাগৃকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ঢাকা সার্কেল) মো. মোস্তফা কামালকে প্রধান করে এ কমিটি করা হয়েছে। তবে অভিযোগের তদন্ত্রের অগ্রগতির বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

জাগৃক কর্মকর্তারা জানান, মিরপুরের ৮ নম্বর সেকশনের দুয়ারীপাড়া এলাকায় গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ওই উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করে জাগৃক। ২৩ একর জমির বেশিরভাগ অংশে থাকা বস্তি উচ্ছেদের কাগজপত্রে ৫ দিনের বিল ভাউচার দেখানো হলেও মূলত ২ দিনেই উচ্ছেদ অভিযান শেষ হয়। বস্তি খালি করে দিতে মাইকিং করা হলে উচ্ছেদের আগের দুই দিনেই বেশিরভাগ লোকজন তাদের আসবাপপত্র নিয়ে যান বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও উচ্ছেদ সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা। তারা আরও জানান, এরপর ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর কয়েকটি বুলডোজার দিয়ে টিনের বেড়া ও কিছু কিছু দেয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পরদিন চারটি ট্রাকের মাধ্যমে তা সরিয়ে নেওয়া হয়। এ উচ্ছেদের জন্য নিয়ম অনুযায়ী প্রায় ৩৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব মাঠপ্রশাসন থেকে পাঠানোর পর তা সংস্থাটির ‘শীর্ষ পর্যায়ে’ গিয়ে পরিবর্তন হয়ে প্রায় কোটি টাকা হয়ে যায়। নানা অসত্য তথ্য যুক্ত করে এ কোটি টাকার হিসাব মিলিয়ে বাড়তি অংশের অর্থ হাতিয়ে নেন সংশ্লিষ্টরা। নিয়ম অনুযায়ী উচ্ছেদে ব্যবহৃত যানবাহন ও অন্যান্য তথ্য রেজিস্টার বইয়ে সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।

জাগৃকের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, দুয়ারীপাড়া আবাসিক এলাকার এ উচ্ছেদের জন্য মাঠ পর্যায় থেকে ৩৫ লাখ ৪ হাজার ৯০০ টাকার প্রস্তাব সংস্থাটির সদস্য (প্রকৌশল ও সমন্বয়) এস এ এম ফজলুল কবির পর্যন্ত অনুমোদন হয়। এরপর জাগৃকের তৎকালীন চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম তা কেটে দিয়ে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরত নির্বাহী প্রকৌশলীকে দ্রুত তার সঙ্গে ‘কথা বলতে’ বলেন। এরপরই পাল্টে যায় উচ্ছেদ অভিযানের খরচের চিত্র। ৩৫ লাখের খরচ হয়ে যায় প্রায় কোটি টাকা। সেই সঙ্গে উচ্ছেদ কাজে ব্যবহৃত বুলডোজার, শ্রমিকের সংখ্যা, অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা, খাবার খরচ, পুলিশ আনা-নেওয়ার জন্য বাসের সংখ্যাসহ সব কিছুরই ব্যয় বাড়ে অস্বাভাবিকভাবে। দুই দিনে শেষ হওয়া উচ্ছেদ অভিযান দেখানো হয় ৫ দিনের। নিয়ম অনুযায়ী জাগৃকের কোনো উচ্ছেদ অভিযানের ভিডিওচিত্রসহ সব ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অভিযান শুরুর আগে জাগৃকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শেখ মিজানুর রহমান উচ্ছেদ কার্যক্রমে নিয়োজিত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহীন মিয়াকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি বলেন, উচ্ছেদ কাজে প্রতিদিন ব্যবহৃত সব বাস, মাইক্রোবাস, ট্রাক, বুলডোজার/এক্সকেভেটরের রেজিস্ট্রেশন নম্বরসহ রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এটি দায়িত্বশীল কর্মকর্তার স্বাক্ষরে সংরক্ষিত হবে। প্রতিদিন ব্যবহৃত যানবাহনের স্থির ও ভিডিওচিত্র ধারণ করে সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু এসব কিছুই করেননি সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাগৃকের নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা ডিভিশন-১) মো. শাহীন মিয়া বলেন, ‘এসডিই (উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী) নিজামুল হক কাজটি বাস্তবায়ন করেছেন। তিনিই ভালো বলতে পারবেন। এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’ বক্তব্য জানতে জাগৃকের তৎকালীন চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। বর্তমান চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হায়দারের ফোনেও যোগাযোগ করে সাড়া মেলেনি। গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের উচ্ছেদের কাজ জাগৃক থেকে হয়ে থাকে। এ উচ্ছেদের নামে কেউ অর্থ হাতিয়ে নিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com