পাপিয়ার কক্ষগামীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে

0

আলোচিত নরসিংদীর মহিলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউর ‘আস্তানায়’ যাতায়াতকারী ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। র‌্যাবসহ তদন্ত সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছেন। তারা আরও বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া যাদের নাম প্রকাশ করেছেন এরই মধ্যে তাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া পাপিয়ার মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তিনি শাসক দলের প্রভাবশালী নেতানেত্রীদের সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলেছেন।

এদিকে গত বুধবার রাতে বিমানবন্দর থানা থেকে পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরীসহ চারজনকে হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের পাপিয়া ও সুমন জানিয়েছেন, তাদের আস্তানায় মূলত বয়স্ক ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল। কারণ তাদের ফাঁদে ফেলা তুলনামূলকভাবে সহজ। র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পাপিয়ার আয়ের প্রায় সব উৎসই অবৈধ। তার মূল উপার্জন ছিল ওপরতলার ব্যক্তিদের ‘মনোরঞ্জন করে’ অর্থ বা সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া। আর এভাবেই তিনি গড়ে তোলেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিত্তবৈভব। মাসের বেশিরভাগ দিনই তার কাটত পাঁচতারকা হোটেলে। মাসে কোটি টাকার ওপরে ভাড়া আসত হোটেল কক্ষের। এমনও দিন গেছে যেদিন পাপিয়ার মদের বিলই এসেছে আড়াই লাখ টাকা।

জাল টাকা উদ্ধার, অস্ত্র ও মাদকের তিন মামলায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পাপিয়া ও সুমন চৌধুরীকে ১৫ দিন এবং তাদের সহযোগী সাব্বির খন্দকার ও শেখ তায়্যিবাকেও রিমান্ডে নেওয়া হয়। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, পাপিয়ার ‘অন্দরমহলে’ নিয়মিত আনাগোনা ছিল সুন্দরী তরুণীসহ শোবিজের উঠতি বয়সীদের। সেখানে ছুটে যেতেন দেশের বড় বড় শিল্পপতি। পাপিয়া ইতিমধ্যে র‌্যাব ও পুলিশের কাছে এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। পাপিয়ার রাজনৈতিক পদচারণার পেছনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতারই হাত ছিল। ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করে তার কাছ থেকেও অনেকেই ফায়দা লুটেছেন। অনেক বড় বড় নেতা ও ব্যবসায়ীর সঙ্গে সখ্য ছিল পাপিয়ার। প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি, সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের বশে আনার জন্য পাপিয়া ‘এস্কট সার্ভিসের’ কারবার শুরু করেন। এজন্য রাশিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে তরুণী আনার কথা স্বীকার করেছেন পাপিয়া।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, পাপিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে যাদের নাম উঠে এসেছে, যাদের ইন্ধনে অন্ধকার জগতে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলে পাপিয়া কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা তাদেরও পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ভিআইপি ব্যক্তিরা দেশের তরুণীদের পাশাপাশি বিদেশি তরুণীদের পছন্দ করতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন পাপিয়া। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই তাদের নিয়ে আসা হতো।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, পাপিয়ার আয়ের উৎস ও আধিপত্য বিস্তারে কে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে সে বিষয়ে তদন্ত করা হবে। এমনকি অনৈতিক বিষয় থাকলেও তদন্ত করে দেখা হবে। তিনি আরও বলেন, পাপিয়ার বিরুদ্ধে র‌্যাব তিনটি মামলা করেছে। ওইসব মামলায় পাপিয়া এখন ১৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। গত বুধবার রাতে মামলাগুলো ডিবিতে হস্তান্তর হয়েছে। এখনো জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ হয়নি।

পুলিশ ও র‌্যাবের দুই কর্মকর্তা বলেন, যেসব ব্যক্তি পাপিয়ার আস্তানায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্তদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পাপিয়ার কাছ থেকে নাম পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শাসক দলের নেতানেত্রী, ব্যবসায়ী, আমলা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা আরও বলেন, পাপিয়ার কললিস্টের বেশিরভাগ নামই ভিআইপির। প্রয়োজনে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব ও পুলিশের ওই দুই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের তালিকায় আসতে পারেন অন্তত ২০ জন। বিষয়টি সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিত করা হয়েছে। তারা বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কৌশলে দলের প্রভাবশালী নেতানেত্রীর সঙ্গে ছবি তুলে নিজের অবস্থান জানান দিতেন পাপিয়া। দলের শীর্ষ নেতাদের বাগে এনে পদপদবিও বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। তার পরিচিতির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে অপরাধ জগতের পরিধিও। পাপিয়া তার অতিথিদের প্রথমেই নিয়ে যেতেন গুলশানের অভিজাত একটি হোটেলে। লাঞ্চ ও ডিনার শেষে নিয়ে যেতেন তার নামে বরাদ্দ করা সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইটে। সেখানে অতিথিদের নিয়ে সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ বৈঠক করতেন পাপিয়া। এরপর পছন্দসই তরুণীকে নিয়ে গোপন কক্ষে প্রবেশ করতেন ভিআইপিরা। ওই হোটেলের ২২ তলায় চার বেডরুমের ওই স্যুইটের প্রতি রাতের ভাড়া দুই হাজার ডলারের মতো। পাপিয়ার রাজ্যে বিচরণ ছিল প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার অনেক শীর্ষ ব্যক্তির। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরাও পাপিয়ার ডাকে সেখানে যেতেন। রিমান্ডে প্রতিদিনই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন তিনি।

পাপিয়ার কার্যকলাপ নিয়ে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘একটি হোটেলে কী ধরনের কার্যকলাপ চলতে পারে, তাদের কী নিয়ম-কানুন আছে তা খতিয়ে দেখা হবে। পাপিয়ার অবস্থানের বিষয়ে হোটেলের কী দায় আছে সেটিও দেখা হবে। এছাড়া তার বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে তারও তদন্ত করা হবে। তিনি আরও বলেন, সরাইখানা আইনে আছে, আবাসিক হোটেলে প্রতিদিন কারা অবস্থান করবে তাদের তালিকা নিকটস্থ থানায় জমা দিতে হবে। দেশি-বিদেশি যারাই থাকুক না কেন, তাদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা জমা দিতে হবে। তবে এত বেশিসংখ্যক আবাসিক হোটেল যে, প্রতিনিয়ত সেটি করা হয় না। প্রতিনিয়ত করলে হোটেল কর্র্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হয় ও পুলিশেরও তদারকিতে অসুবিধা হয়। তাই খুব বেশি তদারকি করা হয় না। এখন থেকে হোটেল পরিচালনার যে নীতিমালা রয়েছে সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হবে। সেখানে যাতে ক্রিমিনাল অ্যাকটিভিটিজ না ঘটে সে ব্যাপারে সজাগ থাকবে পুলিশ।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com