বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ল

0

ব্যবসা ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের আঘাত, পণ্যমূল্যে নাকাল ভোক্তারা। আর এ সময়ে বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়াল সরকার। এতে সাধারণ গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল বাবদ খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়বে বড় বড় শিল্প কারখানাগুলোরও। আর উৎপাদন খরচ বাড়ায় পণ্যমূল্যও বাড়বে, ভোক্তাদের প্রতি মাসে গুনতে হবে বাড়তি টাকা। বিদ্যুতের এই বাড়তি দাম মার্চ থেকে কার্যকর হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মূল্য বৃদ্ধির এ ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), পরে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে কমিশন।

খুচরা পর্যায়ে ব্যবহার করা বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট বা কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাম বাড়ানো হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বা ৩৬ পয়সা। এ ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের দাম ৬ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়েছে। অর্থাৎ আগে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহারে ১০০ টাকা বিল দিতে হতো, এখন একই পরিমাণ ব্যবহার করে ১০৫ টাকা ৩০ পয়সা বিল দিতে হবে।

আর পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ৪০ পয়সা বা ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। ৪ টাকা ৭৭ পয়সা থেকে বেড়ে প্রতি ইউনিটের দাম হয়েছে ৫ টাকা ১৭ পয়সা। এছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন মূল্যহার বা হুইলিং চার্জ প্রতি ইউনিটে শূন্য দশমিক ২৭৮৭ টাকা থেকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে শূন্য দশমিক ২৯৩৪ টাকা।

বিদ্যুতের এই দাম বৃদ্ধিকে ভালোভাবে দেখছেন না ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ব্যবসায়ী ও সাধারণ গ্রাহকরা। তারা বলছেন, গণশুনানির সময় তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরে আমরা প্রমাণ করেছিলাম যে, দাম বাড়ানোর তো দরকার নেই-ই; বরং দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করা বিদ্যুতের দাম আরও কমানো সম্ভব। ব্যবসায়ীদের মতে, এমনিতেই করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যবসায় মন্দাভাব নেমে এসেছে। এ সময়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ব্যবসায় খরচ আরও বাড়াবে, যার প্রভাব পড়বে পণ্যমূল্যে। আর ভোক্তারা বলছেন, পণ্যমূল্য বাড়ায় এমনিতেই সাধারণ ভোক্তাদের ত্রাহি অবস্থা। এ অবস্থায় রোজার আগে আগে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়াবে।

দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। কারণ বড় বড় কারখানা-মেগা প্রকল্প ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হিসাব করা হয় বিদ্যুতের বর্তমান দাম ধরে। এভাবে বছর বছর বিদ্যুতের দাম বাড়লে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, খুচরা পর্যায়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হারে দাম বাড়ার অর্থ হলো, শিল্পের উৎপাদিত প্রতি ইউনিট পণ্যে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় বাড়বে এ হারে।

একটি কারখানার মোট খরচের ৩০-৪০ শতাংশই খরচ হয় বিদ্যুতে। এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো না। এ সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দুঃখজনক। করোনাভাইরাস ও বিদ্যুতের বাড়তি দাম মিলে গ্রাহকের ওপর চাপ বাড়বে।

দেশের শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, একদিকে করোনাভাইরাসের আঘাত, অন্যদিকে পরিবহন ব্যয়সহ সব খরচ বাড়ছে। তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতারা দিন দিন দাম কমাচ্ছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। অনেক কারখানাই এই বাড়তি ব্যয় বহন করতে পারবে না। শিল্প বাঁচাতে হলে সরকারকে আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, গত চার বছর ধরে পোশাক খাতের ব্যয় বেড়েছে ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ, যদিও এ সময়ে বিদেশি ক্রেতারা পোশাকের দাম কমিয়ে দিচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, যা বহন করার সামর্থ্য পোশাক শিল্পের নেই।

ভোক্তা স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্য সচিব গোলাম রহমান বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে গণশুনানি চলাকালে আমরা অনেক তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে দেখিয়েছি যে, দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তিকতা নেই। বরং দুর্নীতি-অপচয় বিবেচনা করলে দাম বাড়ানো পুরোপুরি অযৌক্তিক বিষয় মনে হয়েছে। তাছাড়া দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের এখন যে নাজুক অবস্থা, তাতে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দেওয়া হলো।

‘ভোক্তাদের সঙ্গে মোটেই কোনো সুবিচার করা হয়নি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানুষের জীবনমানে ব্যাঘাত ঘটবে’ যোগ করেন তিনি।

বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বাসাবাড়ির মানুষ ক্ষুব্ধ উল্লেখ করে বাংলাদেশ হাউজ অ্যান্ড ফ্ল্যাট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, সামনে রমজান, এ সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো দুঃখজনক। গণশুনানিতে আমরা বলেছি যে, দাম বাড়ানো দূরের কথা, অপচয়-দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে বিদ্যুতের দাম আরও কমানো সম্ভব। কিন্তু কে শুনে কার কথা!

তিনি বলেন, মানুষ এমনিতেই কষ্টে আছে। তাদের কষ্ট আরও বাড়বে। মানুষ হয়তো রাস্তায় নামে না, কিন্তু তারা খুবই ক্ষুব্ধ। আর এটাই সরকারের জন্য ইতিবাচক ব্যাপার। সরকার বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়েছে, লোডশেডিং কমেছে। সেজন্য সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু ইচ্ছামতো দাম বাড়ানো উচিত নয়। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি।

শেরপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান রওশন বলেন, এমনিতেই চালের দাম বাড়তি। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্ত চালের দাম আরও বাড়াবে। কারণ চাল উৎপাদনে খরচ বাড়বে।

রাজধানীর রায়েরবাগ এলাকার গৃহিণী অনামিকা অনা জানান, দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে কীভাবে সংসার চালাবে সাধারণ মানুষ? বাজারেও সব পণ্যের দাম বাড়তি, সন্তানের লেখাপড়ার খরচও বাড়ছে। কিন্তু সংসারে আয় বাড়েনি। বিদ্যুতের বাড়তি বিল দিতে হলে অন্য খাতে ব্যয় কাটছাঁট করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর জুনের শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দুই মাসের মাথায় বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে প্রস্তাব পাঠাতে শুরু করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এসব প্রস্তাবের ওপর গত ২৮ নভেম্বর শুরু হয় গণশুনানি। তাতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) পাইকারিতে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়।

তাছাড়া বিতরণকারী বা খুচরা বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডেসকো, ডিপিডিসি, ওজোপাডিকো ও নেসকো দাম বাড়ানোর আবেদন করে। যুক্তি হিসেবে পরিচালন ও জনবল বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন ও সরঞ্জামের মূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয় কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে। তবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) পক্ষ থেকে বলা হয়, পাইকারিতে দাম না বাড়লে তাদের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। গণশুনানিতে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন সংগঠন এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। নিয়ম অনুযায়ী গণশুনানির ৯০ দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানাতে হয় বিইআরসিকে। ৯০ দিন পূর্ণ হওয়া এক সপ্তাহ আগেই দাম বৃদ্ধির ঘোষণা এলো।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com