একাধিক সম্পর্ক, ভেঙে যায় এনগেজমেন্টও, আসুন জেনে নিই শারাপোভার জীবনের উত্থান-পতন
চার বছর বয়সে হাতে র্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিলেন বাবার বন্ধু। কয়েকটা বসন্ত পেরিয়ে সেই শিশু নিজেই টেনিসের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিভার পাশাপাশি যেন গ্ল্যামারের প্রতিশব্দও ‘মারিয়া শারাপোভা’। দেড় দশকের ক্যারিয়ার শেষে তার অবসরে শেষ হল টেনিস কোর্টে গ্ল্যামার কোশেন্টের রুশ উপকথার এক অধ্যায়।
বিখ্যাত দুই ফ্যাশন পত্রিকা ‘ভোগ’ এবং ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’-এ বুধবার শারাপোভা লিখেছেন, ‘‘টেনিস, আমি তোমাকে গুডবাই জানালাম। টেনিস র্যাকেট হাতে ২৮ বছর কাটিয়ে আর পাঁচটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার পরে আমি এখন অন্য শৃঙ্গ জয় করতে তৈরি।’’
মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে তার এই সিদ্ধান্তে ভক্তরা আশাহত হবেন ঠিকই। কিন্তু টেনিস-সুন্দরী তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। ‘‘আমি টেনিসকে নিজের জীবন দিয়েছিলাম, টেনিসও আমাকে নতুন জীবন দেয়,’’ বিদায়বার্তায় লিখেছেন তিনি।সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ন্যাগান প্রদেশে মারিয়া শারাপোভার জন্ম ১৯৮৭ সালের ১৯ এপ্রিল। তার এক বছর আগে ঘটেছে ভয়ঙ্কর চের্নোবিল বিস্ফোরণ। তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে শিশুকন্যাকে নিয়ে সোচি চলে এসেছিলেন শারাপোভার বাবা-মা।
সোচিতেই জীবনে প্রথম র্যাকেট ধরেছিলেন মারিয়া। দিয়েছিলেন তাঁর বাবার বন্ধু আলেকজান্ডার কাফেলনিকভ। আলেকজান্ডারের ছেলে ইয়েভজেনিও বিশ্বমানের টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। প্রথমে বাবার সঙ্গে স্থানীয় পার্কে গিয়ে খেলেন শারাপোভা। পরে মেয়ের উৎসাহ দেখে তাকে প্রশিক্ষক ইউরি ইউৎকিনের কাছে পাঠান তার বাবা ইউরি শারাপোভা। ওই বয়সে মারিয়া শারাপোভার হাত ও চোখের সমন্বয় মুগ্ধ করেছিল কোচ ইউরি-ইউৎকিন-কে।
মস্কোয় এক টেনিস প্রশিক্ষণ শিবিরে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার চোখে পড়েন মারিয়া। তার বাবাকে মার্টিনা পরামর্শ দেন মেয়েকে নিয়ে আমেরিকায় যেতে। ফ্লোরিডায় আইএমজি অ্যাকাডেমিতে শারাপোভাকে পেশাদার প্রশিক্ষণ নিতে বলেন মার্টিনা।
১৯৯৪ সালে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শারাপোভাকে নিয়ে তার বাবা এসে পৌঁছলেন আমেরিকা। হাতে সম্বল মাত্র ৭০০ ডলার। তার উপর, তখন তারা কেউই ইংরেজি বলতে পারেন না। বোঝেনও না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেলেন না তার মা ইয়েলেনা। দু’বছর মাকে ছাড়াই থাকতে হয় শারাপোভাকে।
আমেরিকায় পৌঁছনোর পর শারাপোভার বাবা সামান্য মজুরিতে বিভিন্ন রকমের কাজ করতে শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে শারাপোভার বার্ষিক ফি মকুব করে আইএমজি। কয়েক বছর পরে খাতায় কলমে তাদের ছাত্রী হয় ৯ বছরের মারিয়া শারাপোভা।
২০০৪ সালে সদ্য সতেরোয় পা দেওয়া কিশোরীর দ্যুতিতে ঝলসে গেল টেনিস দুনিয়া। উইম্বলডন ফাইনালে সেরিনা উইলিয়ামসকে হারিয়ে শারাপোভা বুঝিয়ে দিলেন, প্রাণোচ্ছ্বল এক তরুণীর রূপান্তর ঘটছে টেনিস-রানিতে। উইম্বলডনের ইতিহাসে শারাপোভা ছিলেন তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ চ্যাম্পিয়ন।
১৮ বছর বয়সে বিশ্বের এক নম্বর নারী টেনিস খেলোয়াড়ের শিরোপা পান শারাপোভা। সেই প্রথম কোনও রুশ নারী টেনিস খেলোয়াড় বিশ্বে এক নম্বর হওয়ার সম্মান অর্জন করেন। পরের বছরই শারাপোভার নামের পাশে যুক্তরাষ্ট্র ওপেন ট্রফি। ২০১২ সালে ফরাসি ওপেন জেতার সঙ্গে দশম নারী হিসেবে ক্যারিয়ার গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ীদের তালিকায় জায়গা করে নেন এই রুশ-সুন্দরী। অলিম্পিকস পদকও আসে এর পরে।
২০১৬ সালের মার্চে, এক সাংবাদিক বৈঠকে শারাপোভা জানান, অস্ট্রেলীয় ওপেনের ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়েছে, তিনি মেলডোনিয়াম নিয়েছেন। হৃদরোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই ওষুধটি নেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নিষিদ্ধ ওষুধের তালিকায় চলে গিয়েছিল মেলডোনিয়াম।
শারাপোভা জানিয়েছিলেন, শারীরিক সমস্যার জন্য সেই ২০০৬ সাল থেকে এই ওষুধ খাচ্ছেন তিনি এবং তিনি জানতেন না মেলডোনিয়াম নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তার আবেদন অগ্রাহ্য করে তাকে প্রথমে দু’বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হয়। পরে যা কমে ১৫ মাসে দাঁড়ায়।
শারাপোভার ক্যারিয়ার-কফিনে কার্যত মূল পেরেক ছিল এই নির্বাসন। এরপর আর কখনওই আগের ফর্মে ফিরতে পারেননি চোট আঘাতে জর্জরিত শারাপোভা।
কিন্তু অবসরের সিদ্ধান্ত কেন? গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ওপেনে সেরিনার কাছে ১-৬, ১-৬ হারের পরেই তিনি বুঝে যান, আর নয়। এবার সময় হয়েছে টেনিসকে বিদায় জানানোর। অতঃপর বিদায় জানালেন শারাপোভা।
কোর্টের বাইরে অগণিত অনুরাগীর হৃদয়ে ঝড় তোলা শারাপোভার জীবনেও এসেছেন একাধিক পুরুষ। ২০০৫ সালে গায়ক অ্যাডাম লেভাইনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। নিজের জন্মদিনের পার্টিতে লেভাইনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল শারাপোভার। কিন্তু সেই প্রেম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
তিন বছর পরে টেলিভিশন প্রোডিউসার চার্লি এবেরসোলের অন্তরঙ্গ হন শারাপোভা। কিন্তু সেই সম্পর্কও ছিল স্বল্পস্থায়ী।
২০০৯ সাল থেকে মারিয়া শারাপোভা ডেট করছিলেন স্লোভেনিয়ান বাস্কেটবল খেলোয়াড় সাশা ভুজাকিকের সঙ্গে। দু’বছর পরে হয় এনগেজমেন্টও। কিন্তু ২০১২ সালে টেনিস সুন্দরী নিজেই জানান, তারা দু’জনে সরে এসেছেন সম্পর্ক থেকে।
২০১৩ সালে মাদ্রিদ ওপেনের সময় মারিয়া শারাপোভা জানান, বুলগেরিয়ার টেনিস খেলোয়াড় গ্রিগর দিমিত্রভের সঙ্গে তার প্রণয়ের সম্পর্ক আছে। কিন্তু দু’বছর পরে ভেঙে যায় সেই সম্পর্কও।
অতীতের এক নম্বর নারী টেনিস খেলোয়াড় মারিয়া শারাপোভা ফোর্বস পত্রিকার বিচারে টানা এগারো বছর ধরে বিশ্বের ধনীতম নারী অ্যাথলিটও ছিলেন। অবসরের পরে কী করবেন? শারাপোভা জানিয়েছেন, এবার সময় কাটবে পরিবার-পরিজন-আলসেমি আর কফির সঙ্গে।