অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আগে রাজনীতি ঠিক করতে হবে: আবদুল আউয়াল মিন্টু
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু। বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান।
দেশের অন্যতম ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান লাল তীর সিড, নর্থ সাউথ সিড, প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্সসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। দায়িত্ব পালন করছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবেও। একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশের বেসরকারি খাত, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিজনেস এডিটর মাসুদ রুমী
দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের সংকট দেখছেন আপনি?
অর্থনীতি যদি ভালো করতে হয় তাহলে দু-তিনটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবার আগে দরকার সামাজিক শৃঙ্খলা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি ঠিক না হয় তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো অসম্ভব। আর নতুন বিনিয়োগ তো হবেই না।
দ্বিতীয়ত হলো ব্যাংকিং খাতের চলমান অস্থিরতা। দীর্ঘদিন ধরে ঋণ বিতরণে নানা অনিয়ম হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা দেখেনি। বহু ব্যাংক বিভিন্ন পরিবার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
তৃতীয়ত, উচ্চ মূল্যস্ফীতি যা নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। একদিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকগুলোর ওপর, আরেক দিক দিয়ে যদি কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হয় তাহলে অস্থিরতা সৃষ্টি হবেই।
যখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের কথা আসে তখন তারা দীর্ঘদিন ধরে সংকুচিত মুদ্রানীতি অনুসরণ করেছে। আবার যখন সরকারের ঋণের বেলায় আসে তখন কিন্তু সংকোচন নেই।
সরকার যত ঋণ চেয়েছে দিয়েছে। এই যে ত্রিমুখী একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংকিং খাতে, এটা কঠোর নীতি অনুসরণ করে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর একটি হলো আইন-শৃঙ্খলাজনিত, আরেকটি ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতাজনিত। সবগুলোর মূলেই কিন্তু রাজনীতি।
সম্প্রতিককালে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সেটা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা কতটা কার্যকর মনে করছেন?
মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হলো উৎপাদন ও সরবরাহ। আগে আমরা এক ধরনের রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত ছিলাম, যাকে আমি দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি বলতে বাধ্য হচ্ছি। এখন আমরা পরিচালিত হচ্ছি সুধীশাসিত রাজনীতি দ্বারা। একেকজন উপদেষ্টার কথা একেক রকম। তাঁরা কি কোনো দিন কোনো উৎপাদনকাজে বিনিয়োগ করেছেন? আমার মনে হয় না। এ জন্য তাঁরা উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বোঝেন না, ব্যবসা-বাণিজ্যও বোঝেন না। তাঁরা সুশিক্ষিত এবং জ্ঞানী-গুণী। অনেক সময় জ্ঞানী-গুণীদের দ্বারা ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের দ্বারা এমন অবস্থা হবে না। ধরেন দেশের ১০০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ৯৯ শতাংশই ভোক্তা। তার মধ্যে ৮০ শতাংশ হলো গরিব, মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত। তারা কিন্তু এখনকার তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সরকার বেশ কিছু সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই সংস্কার সফল করতে গেলে করণীয় কী?
এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে লেজুড়বৃত্তি না করলে ব্যবসা চালাতে পারবেন না, ব্যাংক থেকে ঋণ পাবেন না। রাজনীতিবিদরাই পরিস্থিতি এ অবস্থায় নিয়ে গেছেন। এখন সব দোষ দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ওপর। গত ১৫-২০ বছরে অর্থনীতিকে গিলে ফেলেছে রাজনীতি। অর্থাৎ যাঁরা রাজনীতি করতেন, তাঁরাই আবার ব্যবসা করতেনা। এখন এগুলো তো এত সহজে আপনারা ঠিক করতে পারবেন না। আপনারা সংস্কারের কথা বলছেন। কয়টা সংস্কার করবেন? সাংবিধানিক সংস্কার লাগবে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার লাগবে। এখন সংবিধান সংস্কার করতে গেলে জনগণকে লাগবে। কিন্তু জনগণের সঙ্গে তো কোনো কাজকারবার দেখছি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করতে পারে। নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার এবং নির্বাচনে যেন কেউ কারচুপি করতে না পারে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই সরকারকে যেন জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
দেশ থেকে দুই লাখ কোটি টাকার মতো পাচার হয়ে গেছে। পাচারের টাকা কি আদৌ ফেরত আনা যাবে?
গভর্নর, অর্থ উপদেষ্টা দুই লাখ কোটি টাকা পাচারের কথা বলেছেন। কিভাবে তাঁরা ফিরিয়ে আনবেন সেটা আমিও দেখতে চাই। তাঁরা আগে বিদেশি আইন-কানুন, বিশ্ববাণিজ্য কিভাবে হয় তা শিখুন, তারপর ফিরিয়ে আনার কথা বলুন।
সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন বলব না। কারণ আমরা তো সমর্থন করি এই সরকারকে। তাঁদের আরেকটু চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করা ভালো। আর কথাবার্তা আরেকটু সীমিত রাখা ভালো। এখনো তাঁদের কথাবার্তা বিভ্রান্তিমূলক। তাঁরা আগে পরিসংখ্যান ঠিক করুন। গভর্নরের দায়িত্ব আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঠিক করা। আর মানি সাপ্লাই যদি সংকুচিত করেন তাহলে তা সরকারের জন্য যেমন সংকুচিত হবে, বেসরকারি খাতের জন্যও তেমনি সংকুচিত হবে। আপনার কাছে আছেই ১০০ টাকা। এখন সরকারকে বেশি টাকা দেবেন আর আমাদের বেসরকারি খাত, যারা সম্পদ সৃষ্টি করে, তাদের কম দেবেন; তাহলে কেমন করে হবে? এসবের কারণে বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ।
আপনি সম্প্রতি বাণিজ্যিক খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। সেখানকার পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
অনেক ব্যাংকই খারাপ অবস্থায় আছে। ন্যাশনাল ব্যাংকও এর বাইরে নয়। দুই বছর বা তিন মাস পর কী হবে তা জানি না। তবে এটুকু জানি, আমরা যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাব। ব্যাংক যাতে ঋণে পরিচালিত না হয় তা নিশ্চিত করব। ব্যাংকিং খাত যদি ঠিক না হয় তাহলে অর্থনীতির কোনো খাতই ঠিক হবে না। কেউ যদি এখান থেকে এক হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করে আর আপনি বলেন ঋণটা আমাকে ফেরত দিতে হবে, তাহলে এটা তো সম্ভব না। দুই, জুলাই-আগস্টে কোনো কাজ হয়নি, কারখানা বন্ধ ছিল। উৎপাদনও হয়নি। এই দায়দায়িত্ব কার? সব কিছু ওই বিনিয়োগকারীর ওপর? তাঁরা বিভিন্ন খাতের মানুষের সঙ্গে বসে আগে আলোচনা করুন। কোন খাতে কী সমস্যা, কোন সমস্যার কারণে ওই খাতে উন্নয়ন হচ্ছে না, সেটা আগে তাঁরা বের করুন।
সিন্ডিকেট থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক সিন্ডিকেট ছিল সবচেয়ে বড়। এই রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের আওতায় বিভিন্ন খাতে ছোট ছোট সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এখন যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তারাও একটা সিন্ডিকেট। পণ্যের মূল্য নির্ধারণ হয় সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। চাহিদা যদি বাড়ে কিংবা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকে, তাহলে মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে—কিছু কিছু পণ্যের সরবরাহ অল্প কয়েকজন লোকের হাতে নিয়ন্ত্রিত। সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু কারওয়ান বাজারে গেলে দেখতে পাবেন, অন্তত ২০০ জন সবজি বিক্রি করছে। ২০০ দোকানদার চিনি বিক্রি করছে। তাহলে ২০০ জন মানুষের সিন্ডিকেট কিভাবে হয়? তার মানে হলো, সিন্ডিকেট হয় ওপরের লেভেলে। সেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। অর্থাৎ যতক্ষণ রাজনীতি ঠিক না হবে, উৎপাদন না বাড়বে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমস্যা বিদ্যমান থাকবে। সংকট আরো বেশি হবে। বর্তমান সরকার যতক্ষণ এই সমস্যা বুঝতে না পারবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগকারীদের সহায়তা না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উৎপাদনে ঘাটতি হবে, উৎপাদন ব্যয় আরো বৃদ্ধি পাবে।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর রুগ্ণ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
এখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় গভর্নর সাহেব বলতে পারবেন। আমরা গভর্নরকে যেভাবে পরামর্শ দিয়েছি, তিনি সেভাবে চলছেন না। তিনি আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে চলছেন। আমি দীর্ঘদিন গভর্নরকে চিনি। তিনি সৎ মানুষ। তবে তিনি যদি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত না নেন তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরো খারাপ হবে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ হবে। আমি তাঁর সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, সমস্যা আছে, আমরা এই সমস্যা আর বাড়তে দেব না। এ জন্য তিনি সহায়তাও করছেন। কিন্তু যতটুকু সহায়তা করছেন তা যথেষ্ট নয়।
দেশের সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, মানুষের চরিত্র—এসব একত্রে এনে সমস্যার সমাধান করতে হবে। তা না করে আপনি যদি আপনার চরিত্রের সততা দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চান, তাতে দেশের সমস্যা আরো বাড়বে।
দেশের প্রায় সব ব্যাবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্বে আসতে সরকারদলীয় পরিচয়কে মুখ্য হিসেবে দেখা হয়েছে। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন কিভাবে হবে?
আমাদের সংস্কার একটাই, সেটা হলো বেসরকারি খাতের সংগঠনগুলোকে দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বের করে আনা। এই সংগঠনগুলো আগেও ছিল। গত ১৫ বছরে দেশের ওপরের দিকে যারা উৎপাদন ব্যবসায় জড়িত এবং যারা অর্থবিত্তের মালিক, তারা দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ সম্পদ সৃষ্টির চেষ্টা করছে, আরেকটি অংশ লুটপাটে সম্পদের মালিক হয়েছে। তারা অর্থনীতিতে ক্ষমতাবান, রাজনীতিতেও ক্ষমতাবান। এ দুই গ্রুপের মধ্যে বিরাট ব্যবধান হয়ে গেছে। এখন একটি গোষ্ঠীই তৈরি হয়ে গেছে, যারা শুধু সম্পদ সৃষ্টি করে; সম্পদ তৈরি করে না। তারা লুণ্ঠনের টাকা আবার পাচার করে নিয়েছে।
দেশে বৈষম্য বাড়ার পেছনে দায় কাদের বেশি?
রাজনীতি ও অর্থনীতি একটা ছাড়া আরেকটা ভালো হয় না। অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। আর রাজনীতিকে পরিশীলিত করে অর্থনীতি। এখন যদি আপনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় চলে গেছে, বৈষম্য বেড়ে গেছে—সেটার জন্য যত না বিনিয়োগকারী, অর্থনীতিতে যুক্ত ব্যক্তি দায়ী, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি দায়ী রাজনীতি। কাজেই আমরা যদি রাজনীতি ঠিক করতে না পারি, তাহলে কোনোকালেই অর্থনীতি ঠিক করতে পারব না। এখন রাজনীতির চেয়ে বেশি সংকটে আছে অর্থনীতি। রাজনীতি ও অর্থনীতি দুই ভাই, আমাদের দুটিই ঠিক করতে হবে। একটি ছাড়া আরেকটি কখনো ঠিক হবে না। যদি অর্থনীতি ঠিক করতে হয়, আয়ের বৈষম্য কমাতে হয়, তাহলে কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের ক্ষমতা কমাতে হবে।
শিল্পাঞ্চলের সাম্প্রতিক অস্থিরতা খাতটির অগ্রযাত্রা কতটা ব্যাহত করবে?
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর উদ্যোগ দেখছি না। তাঁরা চেষ্টা করছেন। আমাদের অনেক সমস্যাও আছে। বেসরকারি খাত এখন মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। গত ১৫ বছরে উৎপাদনশীলতা কমতে শুরু করে, গত পাঁচ বছরে তা আরো কমে গেছে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নেই। উল্টো সামাজিক বিশৃঙ্খলা, শ্রমিক অসন্তোষ বেড়ে গেছে। কারখানাগুলোতে হামলা, আন্দোলন চলছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। যেকোনো মূল্যে এই পরিস্থিতির সমাধান দরকার।
উৎপাদনশীলতা কমলে অভ্যন্তরীণ বাজারে কী প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন?
দেশে শিল্প-কারখানা ঠিকমতো চলছে না। উৎপাদন ঠিকমতো হচ্ছে না। উৎপাদন যদি না হয়, রপ্তানি ছাড়াও আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন করতে হয়, দেশের উৎপাদন না বাড়ালে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। কিভাবে সরকার উৎপাদনশীলতা, রপ্তানি বাড়াবে, তার কোনো লক্ষণ দেখছি না।
দেশের ভালো ব্যবসায়ীরাও খেলাপিতে পরিণত হচ্ছেন। সমাধান কিভাবে হবে?
যখনই স্বল্পমেয়াদি আমানতের অধীনে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ঋণ দেওয়া হয়, তখন শেষমেশ ব্যাংক বিপদে পড়ে। সেটা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। অনেক উদ্যোক্তা শিল্প গড়েছেন, কিন্তু মুনাফা করতে পারছেন না। এরপর ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয় বারবার। একটা পর্যায়ে ঋণটা খেলাপি হয়ে যায়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তাধারা ও অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় সমস্যা আছে। সরকারের পতনের আগেও বেসরকারি খাত ভালো ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকারের বেসরকারি খাতের প্রতি কোনো মনোযোগ আমি দেখছি না।
অর্থনীতিতে একটা বিপর্যয় রেখে গেছে বিগত সরকার। উন্নয়নের এত কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে কী ছিল?
বিগত সরকার দলীয় লোক ছাড়া সব মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। আবার মুষ্টিমেয় লোকের জন্য এই অধিকার ছিল অতিমাত্রায়। তারা যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারত। এর ফলে যেটা হয়েছে সেটা হলো, নেতারা প্রতিষ্ঠানগুলো দখলে নিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ যত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আছে, সব দখলে নিয়েছিল। এ ছাড়া যত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন—এফবিসিসিআই) তাদের কবজায় নিয়েছিল। নিয়ন্ত্রণে নিয়ে তারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। ফলে এমন এক জায়গায় আমাদের অর্থনীতি নিয়ে গেছে, যাতে মুষ্টিমেয় লোকের জন্য শুধু ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া সম্ভব ছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি, অর্থনীতি মুষ্টিমেয় লোকের হাতে তুলে দেওয়ার ফলে উৎপাদনব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে, মানুষের উদ্যম ও উদ্যোগের ব্যবহারের ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য খুবই খারাপ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া সঠিক তথ্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় উপস্থাপন করত না। এত দিন মানুষ এটা বলার সুযোগ পায়নি।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিভক্তি কমাতে আপনি আগেও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আপনার এখনকার চিন্তা কী?
আজ ব্যবসায়ী সমাজের যে দ্বিধাবিভক্তি, সেটা আমি একতাবদ্ধ করতে চেয়েছিলাম বহু আগেই। আমি ২০০৪ সালে যখন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলাম, তখন একটি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিভাবে আমাদের বিভক্তি কিছুটা কমানো যাবে, সেই পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। চেষ্টা আমি আগেও করেছি, এখনো করছি। কিন্তু দিন দিন বিভক্তিটা আগের চেয়ে আরো বেড়েছে। সুযোগ পেলেই ব্যবসায়ীরা দল বদল করবেন, এটা ঠিক না। কে কোন দল করেন, আজ থেকে ভুলে যান। ব্যবসায়ীদের কাজ হলো খাতের সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সরকারের কাছে তুলে ধরা। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র চাই। জবাবদিহি প্রয়োজন। মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থের জন্য আর কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা আমলাতন্ত্রকে কাজ করতে দেওয়া হবে না। আমি এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলাম বিএনপির সময়। কেউ বলতে পারবে না, তখনো আমি কারো দলীয় পরিচয় জিজ্ঞেস করেছি। আমাদের কাজ খাতভিত্তিক ব্যবসার সমস্যা তুলে ধরে ব্যবসার পথ সুগম করতে সরকারকে চাপে রাখা।
ফ্যাসিবাদ থেকে বেরিয়ে আসার পর শিল্প-কারখানায় হামলা, মালিকদের নামে মামলাসহ নানাভাবে হয়রানি করার ফলে অর্থনীতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক করতে পারবেন না। ব্যবসায়ীরা সম্পদ সৃষ্টি করে, সেবা করে এবং ব্যবসা করে; করও দেয়। আর যে সম্পদ অর্জন করে, সে করও দেয় না, বিনিয়োগও করে না; সম্পদ রক্ষা করার জন্য বিদেশে পাচার করে। এ গোষ্ঠীটা সবাই এক। যখন নতুন সরকার এসে বলে অর্থ পাচারকারীদের ধরবে, শেষ পর্যন্ত গিয়ে ধরে কিন্তু সম্পদ সৃষ্টিকারীদেরই। যারা দেশে আছে, দেশের উন্নয়নে কাজ করছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে—সবাই ধরে তাদেরই। যতক্ষণ সমাজে সম্পদ সৃষ্টিকারী ও সম্পদ অর্জনকারীদের আলাদা না করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। বিনিয়োগকারীদের যদি ধরে নিয়ে যান, নানা রকমের অন্যায়-অবিচার করেন, তাহলে এত সহজে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে না। আমাদের দেশে যারা বিনিয়োগ করে, সম্পদ সৃষ্টি করে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে—সব দায়দায়িত্ব তাদের ওপর গিয়ে পড়ছে।
ঋণ খেলাপের প্রবণতা বেড়েছে। এতে আমাদের আর্থিক খাত ধ্বংস হয়েছে। সার্বিকভাবে আর্থিক খাতের দুরবস্থা নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পারার ঘটনা আরো বৃদ্ধি পাবে। এর অন্যতম কারণ হলো প্রতিষ্ঠান দখল করা। প্রতিষ্ঠানগুলো একটা গোষ্ঠীর করায়ত্তে চলে যাওয়া বা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। গত ১৫ বছরে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একটি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে তাদের মিত্ররা দখলে নিয়েছে। এর মধ্যে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থাও রয়েছে। আমরা দেখেছি, একটা গোষ্ঠী ১০-১২টি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাকি ব্যাংকগুলোও কোনো না কোনো পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এগুলো দুনিয়ার ইতিহাসে খুবই বিরল ঘটনা। এখন ধরেন, একজন বিনিয়োগকারীর পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। আগে সুদের হার ৯ শতাংশ ছিল, কিন্তু বর্তমানে সেটা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে গেছে। বিনিয়োগকারী বর্তমানে কাঁচামালের অভাবে উৎপাদন ও এলসি করতে পারছে না। কাঁচামাল আমদানি করতে পারলেও ডলারের দাম বাড়ার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে দুর্নীতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং সুদের হার বৃদ্ধি।
এই তিনটি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই বাড়বে। কিন্তু এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য যদি আপনি বিনিয়োগকারীকে প্রশ্ন করেন, তাহলে সেটা কষ্টকর বিষয়। যারা কোনো দিন বিনিয়োগ করেনি, সম্পদ করেনি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেনি, তারা জোরজবরদস্তি করে একটা জিনিস চাপিয়ে দিচ্ছে বিনিয়োগকারীদের ওপর। সমাজের এই উল্টো পদ্ধতি যতক্ষণ ঠিক না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে না, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে না, কর্মসংস্থানও বাড়বে না। কর্মসংস্থানের জন্যই তো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। তাহলে বৈষম্য কিভাবে কমবে আপনি বলেন।
চলমান সংস্কার কিভাবে সার্থক করা যায়?
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করেছে। আমরাও সংস্কার চাই। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কারকে সার্থক করতে রাজনৈতিক লোকদের দিয়ে সংস্কার করতে হবে। আমরা আন্দোলন করেছি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য। আশা করি আমাদের সেই স্বপ্ন দ্রুতই পূরণ হবে।
ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি কোথায় দেখতে চান?
সাধারণ অনুন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হোক বাংলাদেশ—এটাই আমার চাওয়া। এই পথে দেশকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে ধরনের আইন, বিধি-বিধান, চিন্তাধারা প্রয়োজন, তা দেখা যাচ্ছে না। আমার চাওয়া হলো, দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাক। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু যখন সে চাকরি পাবে না, তখনই বৈষম্য সৃষ্টি হবে। তখন সে রাস্তায় মারামারি করবে, চুরি করবে, ডাকাতি করবে। তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ জন্য দায়ী হলো তাঁরা, যাঁরা দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। দেশের রাজনীতিবিদরা মনে করেন, বিনিয়োগকারীরাই অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আসলে তা নয়। অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রক হলেন রাজনীতিবিদরাই। সুতরাং সব কিছু ঠিক করতে হলে প্রথমে রাজনীতি ঠিক করতে হবে।
আমার চাওয়া হলো—পরিবেশ ঠিক করেন এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঠিক করেন, যাতে আমরা বিনিয়োগ করার সুযোগ পাই। রাজনীতিবিদরা সম্পদ চুরি করতে পারেন, কিন্তু সৃষ্টি করতে পারেন না, যেটা বিনিয়োগকারী উৎপাদনের মাধ্যমে, উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে করে থাকেন।
এত বড় একটা অভ্যুত্থানের পরও কি দেশের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না? আপনি কী মনে করেন?
এটা তো এখন বলা যাচ্ছে না। যখন নির্বাচন হবে, একটা রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তখন আমরা দেখতে পারব তারা ক্ষমতা কিভাবে ব্যবহার করছে। এটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে আমার রাজনৈতিক দল ৩১ দফা উল্লেখ করে সংস্কার করার প্রস্তাব দিয়েছে। তাতে আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমার দল সংস্কার করবে। অন্যদের কথা আমি বলতে পারব না। একটা কথা বলি, যতক্ষণ জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। কারণ এখানে কিছু সাংবিধানিক সংস্কার আছে, কিছু আছে প্রাতিষ্ঠানিক, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার, পরিদর্শকদলের সংস্কার। এগুলো করতে কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তু যখনই সাংবিধানিক ও আইনগত সংস্কার করতে যাবেন, তখনই কিন্তু জনগণের কাছে জবাবদিহির বিষয়টি প্রয়োজন হবে। কারণ এটা না হলে সংস্কারগুলো টেকসই হবে না। দেশের পুরনো ইতিহাস যদি দেখেন তাহলে দেখবেন, এক-এগারোর সরকার ১৮৯-১৯০টা আইন সংস্কার করেছে। অনেক পরিবর্তন করেছে। বিগত সরকার এই সংস্কারগুলো আইনে পরিণত করার ওয়াদাও করেছিল। কিন্তু পরে শুধু পাঁচ-ছয়টি আইনে সংশোধন এনে পাস করা হয়। সেগুলোতেও এমন কাটাছেঁড়া করা হয়, যা আগের অবস্থার চেয়েও খারাপ হয়েছে। সুতরাং টেকসই সংস্কার করতে চাইলে জনগণের মতামত নিতে হবে। যদি জনগণের মতামত না নেন, তাহলে পরবর্তী সরকার সেই সংস্কার কতটুকু করবে তার নিশ্চয়তা নেই।