ইসরায়েলে সামরিক সহায়তা বন্ধের পক্ষে বেশিরভাগ মার্কিনি, পরোয়া নেই রাজনীতিকদের
গত মাসে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএস-এ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হ্যারিস। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সঞ্চালক ডানা ব্যাশ তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্রের কিছু চালানে রাশ টানতে আগ্রহী? আপনার কাছে প্রগতিশীল বামপন্থিদের অনেকের চাওয়া কিন্তু সেটাই।’
প্রশ্নটি হ্যারিস প্রথমে পাশ কাটিয়ে যান। তিনি কথা বলেন গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে। তারপর তিনি বলেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাইডেন প্রশাসনের দেখানো পথেই তিনি চলবেন।
তবে জরিপ একটি ভিন্ন গল্প বলছে। কেবল ‘প্রগতিশীল বামপন্থীরা’ নয়, ইসরায়েলকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধের পক্ষে আছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার। একই সঙ্গে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার প্রতিও সমর্থন বাড়ছে।
এই বিষয়ে গবেষক ইউসেফ মুনাইয়ের বলেছেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহে সমর্থনকারীর চেয়ে বিরোধীর সংখ্যা বেশি।’ নিজ কথার সমর্থনে মার্কিন প্রচারমাধ্যম সিবিএস-এর জুন মাসের এক জরিপের উল্লেখ করেছেন তিনি।
জরিপে দেখা গিয়েছিল, ৬১ শতাংশ মার্কিনি ইসরায়েলে অস্ত্র প্রেরণের বিপক্ষে। এরমধ্যে ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের ৭৭ শতাংশ আর রিপাবলিকান ৪০ শতাংশ সমর্থকও আছেন। বেশ কয়েকমাস ধরেই জরিপের ফল প্রায় অপরিবর্তিত থাকছে।
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পরিচালিত একাধিক জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহে কিছু বিধিনিষেধ চায় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক। এমনকি যুদ্ধবিরতির পক্ষেও আছেন অসংখ্য মানুষ।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের সংঘর্ষ শুরু হওয়ার দু’সপ্তাহ পর একটি জরিপ করে সিবিএস। ১ হাজার ৮শ’ মার্কিনির ওপর করা সে জরিপে ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহের বিপক্ষে ছিল ৫২ শতাংশ মানুষ।
এরপর, চলতি বছর এপ্রিলে একই প্রশ্নের ওপর চালানো তাদের আরেক জরিপে দেখা যায়, ৬০ শতাংশ নাগরিক ইসরায়েলে অস্ত্রের চালান পাঠানোর বিপক্ষে।
জুন মাস নাগাদ যুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার ফিলিস্তনি প্রাণ হারানোর পরও অভিযান অব্যাহত রাখে ইসরায়েল। রাফা অঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর যখন হামলা চলতে থাকে, তখন ‘অল আইজ অন রাফা’ (সবার নজর রাফায়) প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেয়ে যেতে থাকে। এবার সিবিএস পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ৭৭ শতাংশ ডেমোক্র্যাট সমর্থকসহ ৬১ শতাংশ মার্কিন নাগরিক ইসরায়েলে মার্কিন সামরিক সহায়তার বিপক্ষে।
এছাড়া, প্রধান সুইং স্টেটগুলোতেও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ চায় অনেক মানুষ।
ইনস্টিটিউট ফর মিডল ইস্টার্ন আন্ডারস্ট্যান্ডিং পলিসি প্রজেক্ট দ্বারা গৃহীত একটি জরিপে দেখা যায়, পেনসিলভিনিয়া অঙ্গরাজ্যের ৫৭ শতাংশ এবং গুরুত্বপূর্ণ সুইং স্টেট অ্যারিজোনার ৪৪ শতাংশ ও জর্জিয়ার ৩৪ শতাংশ ভোটার জানিয়েছেন, ইসরায়েলে সামরিক সহায়তা বন্ধের নিশ্চয়তা পেলে হ্যারিসকে তারা মনোনীত করবেন।
মুনাইয়ের বলেছেন, ‘ব্যাপারটা এখন আর কেবল প্রগতিশীল বামপন্থিদের ইস্যু নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্র্যাট সমর্থকরাও এখন ইসরায়েলে সামরিক সহায়তা বন্ধ দেখতে চায়। গাজায় যা হচ্ছে, তা দেখার পর যে কোনও বিবেচক মানুষই এমনটা চাইবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
কিন্তু এত বিরোধিতা সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েই যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত হাজারো ২ হাজার পাউন্ডের বোমা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া গতমাসে ইসরায়েলের জন্য আরেকটি সামরিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর ও মানবাধিকার কর্মীদের আহ্বান উপেক্ষা করে নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে প্রশাসন।
নির্বাচনি দৌড় থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সরে দাঁড়ানোর পর, ডেমোক্র্যাট শিবিরের মশাল এখন কমলা হ্যারিসের হাতে। মঙ্গলবারের নির্বাচনি বিতর্কে ফিলিস্তিন ইস্যুতে নিজের অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেছেন, তিনি গাজা যুদ্ধবিরতি চান, তবে শক্তিশালী ইসরায়েলও তার কাম্য। তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আদর্শেই চলবেন।
সামরিক সহায়তা বিরোধীদের সবচেয়ে প্রচলিত আইনত হচ্ছ ১৯৯৭ সালের লিথি আইন। এই আইন অনুযায়ী মানবাধিকার ভঙ্গকারী কোনও দেশকে সামরিক সহায়তা পাঠানো নিষিদ্ধ।
এছাড়া কয়েকজন ডেমোক্র্যাট সিনেটর ১৯৬১ সালের বৈদেশিক সহায়তা আইন ব্যবহার করে দাবি করেছেন, মানবিক সহায়তা প্রদানে বাঁধা দেয় এমন কাউকে সামরিকভাবে সাহায্য কর যায় না। এই আইন প্রয়োগের জন্য মার্কিন ত্রাণ সহায়তা গাজায় প্রবেশে বাঁধা দেওয়া ইস্যুতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রীসভার কৃতকর্মের যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ মজুদ আছে।
জুনে পরিচালিত আরেক জরিপে দেখা গিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত না হলে সামরিক সহায়তা বন্ধের পক্ষে আছে ৫৩ শতাংশ মানুষ। এরমধ্যে ৭০ শতাংশ ডেমোক্র্যাট সমর্থক ও সুইং স্টেটের ৫৩ শতাংশ মানুষ রয়েছেন। নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মাসখানেক পরই এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন মার্কিনিরা।
আগস্টে শিকাগো কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ ডেমোক্র্যাট সমর্থকসহ মোট ৫৩ শতাংশ মার্কিনি ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্রাসন বন্ধে ইসরায়েলে সামরিক সহায়তার বিপক্ষে। অবশ্য ৬০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছিলেন, জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা সামরিক সহায়তায় সমর্থন দিয়ে যাবেন।
ডাটা ফর প্রগ্রেস পরিচালিত জুন মাসের জরিপে দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ মার্কিনি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চাচ্ছে।
একাধিক গ্যালপ জরিপে দেখা গেছে, ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে ধীরে ধীরে মার্কিনিরা গাজা যুদ্ধে আপত্তি জানানো শুরু করেছে। গত নভেম্বরে ইসরায়েলের সমর্থনে ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ মার্কিনি। প্রায় চার মাস পর, প্রায় ৫৫ শতাংশ নাগরিক জানায়, তারা গাজা যুদ্ধে তাদের সমর্থন নেই। অবশ্য এই সংখ্যাটা জুনে ৪৮ শতাংশে নেমে আসে, যেখানে ডেমোক্র্যাট সমর্থক ছিলেন ৭৭ শতাংশ।
চলতি মাসের শুরুর দিকে ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহে রাশ টেনে ধরার ঘোষণা দেয় যুক্তরাজ্য। যদিও মাত্রাটা খুবই ছোট, ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের ৩৫০ টি চুক্তির কেবল ৩০ টি বাতিল করা হচ্ছে। আর ইতালি, বেলজিয়াম, কানাডা, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের মতো দেশ তাদের বন্দরে ইসরায়েলের জন্য অস্ত্রবহনকারী জাহাজ ভেড়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ইন্টারন্যাশনাল পলিসি সেন্টারের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের সাবেক পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা, ম্যাট ডাস, সিএনএন-এ হ্যারিসের সাক্ষাৎকারের পর সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, ইসরায়েলে অস্ত্র চালান সীমাবদ্ধ করা ৭ অক্টোবরের প্রেক্ষাপটে শুরু হওয়া কোনও বিষয় নয়। বরং দলের মধ্যে অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয় একটা ধারণা ছিল এটি।
ডাস বলেছেন, ‘এটা নতুন বা আকস্মিক কোনও পরিবর্তন নয়। ডেমোক্র্যাটিক ভোটারদের মধ্যে বিহু বছর ধরেই এটি একটা নিয়মিত আলোচিত বিষয়।’
৭ অক্টোবরের আগে, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর দখল ও তাদের বসতি স্থাপন, সেনাবাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন- এগুলোই ছিল প্রধান উদ্বেগের ক্ষেত্র। এরপর ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স, এলিজাবেথ ওয়ারেন, পিট বুট্টিগিয়েগ, জুলিয়ান ক্যাস্ট্রো শর্তসাপেক্ষে সমর্থন দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে পশ্চিম তীরে দখল বৃদ্ধির হার হ্রাস পাবে।
২০২০ নির্বাচন শেষে, উদারপন্থি ইহুদি লবিস্ট গোষ্ঠী জে স্ট্রিট পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ফিলিস্তিনে দখলদারি কমাতে সামরিক সহায়তার পরিমাণ কমানোর পক্ষে ৫৭ শতাংশ আমেরিকান ইহুদি।
এ বিষয়ে ডাস বলেছেন, ‘জরিপের ফলের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণের জন্য আমি পরামর্শ দিচ্ছি না। আমি কেবল বলতে চাচ্ছি, এটা একটা ধারাবাহিক প্রবণতা। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে এভাবে চিন্তা করার অভ্যাস আছে।’
তথ্যসূত্র: দ্য ইন্টারসেপ্ট