সড়ক নিরাপত্তায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কিছুই কাজে আসছে না
সড়ক নিরাপত্তায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, শত শত সুপারিশ, টাস্কফোর্স– কিছুই কাজে আসছে না। সরকারি হিসাবেই আগের বছরের প্রথম তিন মাসের চেয়ে এ বছর দুর্ঘটনা ৪৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনার পর গাড়ি কিংবা সড়কের ত্রুটি সামনে আসছে। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), হাইওয়ে পুলিশসহ সরকারের নানা সংস্থা অনিয়ম রোধে থাকলেও আগেভাগে ত্রুটি ধরা পড়ে না।
গত বুধবার খুলনা-ঝালকাঠি মহাসড়কের গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাক কয়েকটি গাড়িকে পিষে দেওয়ায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনার পর জানা যায়, চালকের নিবন্ধন ছিল হালকা শ্রেণির, ট্রাক চালানোর অনুমতিই ছিল না। ২০১২ সালের এক্সেল লোড নীতিমালা অনুযায়ী, ট্রাকটি ১৩ টন পণ্য পরিবহনে সক্ষম হলেও তাতে ৪০০ বস্তা সিমেন্ট তথা ২০ টন মালপত্র ছিল। নিয়ম অমান্য করে অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই ট্রাকটি খুলনা থেকে বিনা বাধায় গাবখান পর্যন্ত চলে আসে।
সড়ক পরিবহন আইনের ৪৩ ধারা অনুযায়ী, অতিরিক্ত ওজন বহন দণ্ডনীয় অপরাধ। ৮৬ ধারা অনুযায়ী, এ অপরাধের শাস্তি অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে দায়ী ব্যক্তি। অতিরিক্ত হিসেবে চালকের নিবন্ধন থেকে ২ পয়েন্ট কাটা যাবে।
গত মঙ্গলবার ফরিদপুরে বাসের সঙ্গে পিকআপের ধাক্কায় ১৫ জন নিহত হওয়ার পরও নানা অনিয়ম সামনে আসে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পণ্যবাহী পিকআপে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছিল। নিহত সবাই ছিলেন পিকআপের চালক বা যাত্রী। বাসটির রুট পারমিট যথাযথ ছিল না। স্থানীয়দের ভাষ্য, সড়কের গর্তে চাকা আটকে বাসটি আড়াআড়ি হয়ে গিয়েছিল।
এত উদ্যোগের পরও অনিয়ম আগে কেন ধরা পড়ে না– প্রশ্নে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী সমকালকে বলেন, বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশ যথাসাধ্য কাজ করছে। বুধবারও সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ বেপরোয়া গতি, কাগজহীন যানবাহন, অতিরিক্ত পণ্য বহন, পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী পরিবহনের বিরুদ্ধে প্রতিদিন মামলা করছে। সড়কে মৃত্যু ও দুর্ঘটনা রোধে সবকিছুই করছে সরকার। অসচেতনতার কারণেই দুর্ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। টাকা বাঁচাতে যাত্রীরা ট্রাক ও পিকআপে উঠে যাচ্ছেন। অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই করা হচ্ছে কিছু টাকা বাঁচাতে।
সচিব বলেন, প্রতিটি বড় দুর্ঘটনার পর তদন্ত হচ্ছে। কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যত দিন মানুষ সচেতন না হবে, তত দিন শুধু আইন প্রয়োগ করে সড়ক নিরাপদ করা যাবে না।
এ বছরেই প্রথমবারের মতো দুর্ঘটনা এবং হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে বিআরটিএ। ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৪৯৫ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ২৪ জন। বেসরকারি সংগঠনগুলোর চেয়ে সরকারি পরিসংখ্যানে হতাহতের সংখ্যা কম। তবে পুলিশের প্রতিবেদনের চেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) হিসাবে, বাংলাদেশে বছরে ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় দুর্ঘটনায়। এ সংখ্যাকে অতিরঞ্জিত বলেছে বিআরটিএ।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে দুর্ঘটনা এবং হতাহতের পরিসংখ্যান রাখছে বিআরটিএ। গত বছরের প্রথম তিন মাসে ১ হাজার ১৭ সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫১ জন নিহত হয়েছিলেন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৬৪ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১ হাজার ৩৬৭ জনের।
বিআরটিএর হিসাবে, গত মার্চে ৬২৪ দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত হয়েছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মাসে ৫৫২ সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৬৫ জন মারা যান। আগের বছরের তুলনায় কেন দুর্ঘটনা বেড়েছে– এ প্রশ্নে বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, আগে সব তথ্য পাওয়া যেত না। সরকার জোর দেওয়ার পর হতাহতের প্রকৃত তথ্য আসছে। এতে সংখ্যা বাড়ছে।
দুর্ঘটনা রোধে বিশ্বব্যাংকের ঋণে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সওজ। তবে প্রকল্প রয়েছে শুরুর ধাপে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত ওভারলোডিং বন্ধে সারাদেশে ২৮টি এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন বা ওজন পরিমাপক কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প চলছে ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকায়। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়ানোর পর এ বছর কেন্দ্রগুলো চালুর কথা। তবে চালুর সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগে নির্মিত ১৭ এক্সেল লোড কন্ট্রোল সেন্টারের ১২টি বিকল। ফলে অতিরিক্ত পণ্য বহন ধরা পড়ে না।
অথচ ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১২ সালে এক্সেল লোড নীতিমালা করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, এর মাধ্যমে বন্ধ হবে অতিরিক্ত পণ্য বহন। পরে পরিবহন নেতা এবং ব্যবসায়ীদের চাপে সরকারই অতিরিক্ত পণ্য বহনের সুযোগ দেয় নীতিমালায়। অভিযোগ রয়েছে, ধরা পড়লেও ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতি তালুকদার মো. মনির সমকালকে বলেন, ওভারলোড নিয়ন্ত্রণের নামে হয়রানি আর ঘুষ আদায় ছাড়া কিছুই হয় না।
সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত পণ্য বহনের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকায় নির্মিত সড়ক-মহাসড়ক টিকছে না। খানখন্দ সৃষ্টি হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। সড়ক পরিবহন সচিব বলেন, জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় এক্সেল লোড কন্ট্রোল সেন্টারের কাজ এগোয়নি। তবে এ বছরেই ১০টি চালু হবে। বাকিগুলো আগামী বছর খুলবে।
এক্সেল লোডের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়। ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশার মতো যানবাহন শুধু মহাসড়কে নয়, চলাচলই নিষিদ্ধ। এগুলোর নিবন্ধন, অনুমোদন কিছুই নেই। তবে গতকাল গাবখান সেতুতে ট্রাক যে পাঁচ গাড়িকে পিষে দিয়েছে, এর তিনটিই ইজিবাইক। নিহতদের ৯ জনই ছিলেন ইজিবাইকের যাত্রী।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে সড়কের নিরাপত্তায় শাস্তি বহু গুণ বাড়িয়ে আইন করা হয়। দুর্ঘটনা রোধে ১১১ দফা সুপারিশ জমা দিয়েছে উচ্চক্ষমতার কমিটি। সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন ছয় দফা নির্দেশনা। কিন্তু সড়কে কিছুই ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্ঘটনাও রোধ হচ্ছে না।
মহাসড়ক নিরাপদ করতে ধীরগতির যানবাহন চলাচলে হাজার হাজার কোটি টাকায় সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সেগুলো দখল হয়ে গেছে। খোদ পুলিশ রয়েছে দখলদারের তালিকায়। মহাসড়কে বসানো হয়েছে স্পিডমিটার, সিসি ক্যামেরা। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
আয়ুষ্কাল ফুরানো বাস এবং ট্রাকের চলাচল বন্ধে গত ১৭ মে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ২০ বছর আর ট্রাকের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হয় ২৫ বছর। কিন্তু পরিবহন মালিকদের আন্দোলনের হুঁশিয়ারির পর গত আগস্টে আয়ুষ্কাল নির্ধারণের প্রজ্ঞাপন স্থগিত করা হয়।
গত মঙ্গলবার ফরিদপুরে দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি ২২ বছরের পুরোনো। ২০ হাজারের মতো ২০ বছরের বেশি পুরোনো বাস এবং ৬০ হাজারের মতো ২৫ বছরের বেশি পুরোনো ট্রাক চলছে সড়কে। সড়ক নিরাপত্তায় পুরোনো গাড়ি উচ্ছেদে স্ক্র্যাপ গাইডলাইনের খসড়া করেও পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসে সরকার।
দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও ভোটে প্রভাব পড়ার শঙ্কায় সড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটির মতো অনুমোদনহীন যানবাহন বন্ধে সরকার আগ্রহী নয়। গত ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় তা বলা হয়েছে।