সরকার চাইলেই বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে পারে খালেদা জিয়াকে, অভাব স্বদিচ্ছার
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ দিন ধরেই লিভার ও হার্টের সমস্যা, আর্থ্রাইটিস, ফুসফুস, ডায়াবেটিস এবং চোখের সমস্যাসহ নানা ধরনের অসুস্থতার চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ জন্য প্রায়ই তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে। তার পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে বিদেশে তার উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেয়ার দাবি করা হচ্ছে। তবে সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- যেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় যে আবেদন ছিল সেটি নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন সে আবেদনের ওপরে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ নেই, শুধু মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া। তবে আইনবিদদের মতে, ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১(১) ধারায় মানবিক কারণে সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দিতে পারে। সরকার যেখানে বারবার তার মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করছে সেখানে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার সুযোগও দিতে পারে মানবিক কারণে। তাদের মতে, সরকারের ব্যাখ্যাটা সঠিক নয়। সরকার নতুন করে যেখানে মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করছে, সেখানে সরকার চাইলে ছয় মাসের জায়গায় মেয়াদ তিন মাসও করতে পারে। আবার বিনা শর্তে মুক্তি দিতে পারে। কাজেই সরকার চাইলে শর্ত পরিবর্তন করতে পারে এবং বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে পারে।
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১(১) ধারা মতে, সাজাপ্রাপ্ত যে কাউকে সাজা স্থগিত করে সরকার মুক্তি দিতে পারে। শর্তহীন বা শর্তারোপ করে। ৪০১(১)-এর বিধান মতে সাজাপ্রাপ্তকে কোনো আবেদন করার প্রয়োজনও হয় না। ৪০১(২)-এর বিধান মতে সরকারের কাছে আবেদন করার বিধানও আছে। ৪০১(৪এ)-এর বিধান মতে সরকার কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত কাউকে মুক্তি দিলে, মুক্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণ মুক্ত। অন্য কোনো আইন দ্বারা বা কোনো কর্তৃপক্ষ তার মুক্ত চলাচলে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সাজা স্থগিত করে, সাজা স্থগিতের মেয়াদ ছয় মাস করে বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশের আইনমন্ত্রী প্রায়ই আইনের উদ্ধৃতি করে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি প্রদানের বিষয়ে অসত্য বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার ফৌজদারি কার্যবিধি ৪০১(১) ধারা মতে, বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে কোনো আবেদন ছাড়া তাকে মুক্তি দিয়েছে। এর পর থেকে বারবার মেয়াদ বর্ধিত করেছে। তিনি বলেন, বিদেশে যাওয়ার যদি সুযোগ না থাকত তাহলে বারবার কোন আইনে বর্ধিত করছেন?
আইনে মুক্ত মানুষকে দেশে-বিদেশে অবাধ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার কোনো আইন নেই।
এ ক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়াকে দেশের কোনো আদালত বিদেশে যেতে বাধা দান করে কোনো আদেশ প্রদান করেনি।
আর সরকার ৪০১(১) ধারা মতে সাজাপ্রাপ্ত যে কাউকে মুক্তি দিলে দেশের কোনো আদালত কোনোরূপ কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।
সুতারাং সরকারের আইনমন্ত্রী প্রায়ই যে কথা বলছেন যে, বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে হলে তাকে আবার জেলে যেতে হবে। এ বক্তব্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার বক্তব্যের সমর্থনে দেশে কোনো আইন নেই। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের কোনো নজিরও নেই। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ মতে সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ মতে, কারো জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে প্রায় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের পরিচর্যায় রয়েছেন। ম্যাডামের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া নিয়ে সরকারের অহেতুক রাজনীতি করা উচিত হবে না। মানবিক কারণে চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া উচিত। তিনি বলেন, ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে সরকার বারবার অমানবিক আচরণ করছে। সরকারকে দ্রুত মানবিক হওয়া উচিত। তা না হলে এটা একটা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। একদিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকেও এর মাশুল দিতে হতে পারে।
এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় বলা আছে- সরকার চাইলে শর্তসাপেক্ষে অথবা শর্তহীনভাবে কোনো সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত, মওকুফ করতে বা কমাতে পারে। তাহলে দেশের হাসপাতালে চিকিৎসার কথা যেখানে বলা আছে, সেখানে বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসার কথা বলতে কেন সরকার পারবে না, এটা আমার বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, সরকার তার মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে বলেছে বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। সরকার প্রথমে মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বারবার বৃদ্দি করছে। বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে বলেছে, জেলে গিয়ে নতুন করে আবেদন করা লাগবে। এটা সরকারের একটি ব্যাখ্যা, এটা সঠিক নয়। সরকার নতুন করে যেখানে মুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করছে সেখানে চাইলে ছয় মাসের জায়গায় মেয়াদ তিন মাসও করতে পারে। আবার বিনা শর্তে মুক্তি দিতে পারে। কাজেই সরকার চাইলে শর্ত পরিবর্তন করতে পারে এবং বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে পারে।
গত ২০ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে চিকিৎসার জন্য তার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে তিনি জানিয়েছিলেন। ২০ মার্চ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আগের শর্তে (বিদেশে যাওয়া যাবে না এবং দেশে চিকিৎসা নিতে হবে) তার মুক্তির মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানোর জন্য মতামত দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে দণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ নির্বাহী আদেশে আটবারের মতো বাড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়ার ভাইয়ের যে আবেদন ছিল ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা মতে, তার (খালেদা জিয়া) সাজা স্থগিত রেখে দু’টি শর্তে যে মুক্তি দেয়া হরয়ছিল। সেটি সাতবার বাড়ানো হয়েছে। একই শর্তে সাজা স্থগিত রেখে মুক্তির আদেশ আরো ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হচ্ছে। আমি এ মতামত দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠিয়েছি।
বেগম জিয়ার পরিবারের আবেদনে ছিল তার স্থায়ী মুক্তি ও বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার। এ বিষয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, আমি এ ব্যাপারে দু’দিন আগেও আপনাদের বলেছি। যেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় যে আবেদন ছিল সেটি নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন সে আবেদনের ওপরে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ নেই, শুধু মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া। ঠিক সে কারণে আমি মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলে সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠিয়েছি।
মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো যাবে কি না, সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, না, যা-ই করতে হবে আইনের মাধ্যমে করতে হবে। যে আইনে তাকে বের করা হয়েছে, সে আইনে এ (বিদেশে পাঠানো) সুযোগ নেই।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় যা বলা হয়েছে : ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলে বিনা শর্তে বা শর্তসাপেক্ষে কারো দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করতে পারে। স্থগিতাদেশের সময় বাড়াতে পারে। আবার শর্ত ভাঙলে স্থগিতাদেশ বাতিলও করতে পারে।
এই ধারায় উপধারা আছে ছয়টি।
উপধারা-১-এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যেকোনো সময় বিনা শর্তে বা শর্তে তার দণ্ড স্থগিত, অংশবিশেষ বা পুরোপুরি মওকুফ করতে পারবে।
উপধারা-২ বলছে, কোনো দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করতে সরকারের কাছে আবেদন করা হলে সরকার দণ্ড প্রদানকারী বিচারকের মতামত নিতে পারে এবং বিচারের নথি পাঠানোর নির্দেশ দিতে পারে।
উপধারা-৩-এ বলা আছে, যেসব শর্তে দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয়েছে, কোনোটি পালন করা হয়নি মনে করলে সরকার সাজা স্থগিত বা বাতিলের আদেশ বাতিল দিতে পারবে। সে ক্ষেত্রে পুলিশ তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবে এবং দণ্ড ভোগ করার জন্য তাকে জেলে পাঠানো যাবে।
উপধারা-৪ অনুযায়ী দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করার শর্ত এমন হবে যা পূরণে সে স্বাধীন থাকবে।
এই ধারার আবার একটি উপধারা আছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোনো ফৌজদারি আদালত কোনো আদেশ দিলে তা সেই ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে বা তার বা সম্পত্তির ওপর দায় আরোপ করতে পারে।
উপধারা-৫ অনুযায়ী, এই ধারা যে ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে, তিনি রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা প্রদর্শনের অধিকারী থাকবেন।
উপধারা-৬ অনুযায়ী সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দিয়ে দণ্ড স্থগিত রাখা এবং দরখাস্ত দাখিল ও বিবেচনার শর্তাবলির বিষয়ে নির্দেশ দিতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে দুই মামলার কারাদণ্ড স্থগিত হওয়ার পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান। তার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৪০১ (১) ধারা অনুযায়ী কারাদণ্ড স্থগিত করে বিএনপি প্রধানকে মুক্তি দেয় সরকার।
প্রথম দফা মুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে এলে ওই বছরের ২৫ আগস্ট বেগম জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে স্থায়ী মুক্তি চেয়ে আবেদন করা হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দ্বিতীয় দফায় ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ছয় মাসের জন্য তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ায়।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালত। রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হয়। এরপর একই বছরের ৩০ অক্টোবর এ মামলায় আপিলে তার আরো পাঁচ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট।
এ ছাড়া একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালত।