ইউক্রেন যুদ্ধ ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে ওয়াশিংটন-বেইজিং ছায়াযুদ্ধে

0

সংঘাতের ৫২তম সপ্তাহে এসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন আর কেবল আঞ্চলিক যুদ্ধ নেই। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টিও। বিশেষ করে, বিশ্বের দুই বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরবিরোধী দুটি পক্ষকে সমর্থন দেওয়ায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে ওয়াশিংটন-বেইজিং ছায়াযুদ্ধে। এটি হয়ে উঠছে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মর্যাদার লড়াই।

২৪ ফেব্রুয়ারি এক বছর পা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আপাতদৃষ্টিতে নিকট ভবিষ্যতে এর সমাপ্তির তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যেই সম্প্রতি আকস্মিক সফরে কিয়েভে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে দৃঢ় কণ্ঠে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ইউক্রেনে কখনোই জিতবে না রাশিয়া, কখনো না!’

যুদ্ধের মধ্যে বাইডেনের ইউক্রেন সফর যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এর প্রতীকী গুরুত্বও অনেক। কিয়েভের রাস্তায় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বাইডেনের পাশপাশি হেঁটে চলা যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। সফরকালে ইউক্রেনকে আরও সামরিক সহায়তা ও সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

বাইডেনের এই সফরের একদিন পরেই যুদ্ধের পক্ষে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সুদীর্ঘ বক্তব্য দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেন, ‘এক বছর আগে, আমাদের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের জনগণকে রক্ষার জন্য, আমাদের দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এবং ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের পরে ইউক্রেনে গড়ে ওঠা নব্য-নাৎসি শাসনের হুমকি দূর করার জন্য সামরিক অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।’

পুতিন বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে এই সমস্যা সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, বস্তুত সব কিছুই করেছি।’ তার মতে, ‘ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হলে রাশিয়ার সীমান্ত কখনোই নিরাপদ থাকবে না।’

২০০৮ সালে ইউক্রেনকে সদস্য করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল ন্যাটো।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন ছায়াযুদ্ধ?
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সম্প্রতি দাবি করেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের কথা ভাবতে শুরু করেছে চীন।

তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের দুশ্চিন্তা, চীন রাশিয়াকে প্রাণঘাতী সহায়তা দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে। আমরা তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, এটি আমাদের এবং আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করবে।’

এসময় ব্লিঙ্কেন নিশ্চিত করেছেন, ‘প্রাণঘাতী সহায়তা’ বলতে তিনি অস্ত্র-গোলাবারুদের কথাই বলেছেন। তবে ঠিক কী ধরনের অস্ত্র, সেটি বলেননি তিনি।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের জবাব দিতে দেরি করেনি চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন পরের দিন বলেন, ‘চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রই যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ঢেলে দিচ্ছে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘চীনকে কী করতে হবে তা বলার মতো কোনো অবস্থানে নেই যুক্তরাষ্ট্র।’

এর আগে, গত বছরের মার্চে জো বাইডেন চীনকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, মস্কোকে সহযোগিতা করলে অবশ্যই তার পরিণতি ভোগ করতে হবে বেইজিংকে।

তবে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মন্তব্য করার বিষয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বরাবরই সতর্ক দেখা গেছে। গত নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ায় জি২০ সম্মেলনের ফাঁকে বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন জিনপিং। সেখানে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত যৌথভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বা হুমকির বিরোধিতা করা।’

তবে এরপরও পারমাণবিক হামলার হুমকি অব্যাহত রাখে রাশিয়া। গত ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষণে সেই ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। এদিন কৌশলগত অস্ত্র প্রশমন চুক্তি বা নিউ স্টার্ট চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া কতগুলো কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে তার সীমা নির্ধারণ করা ছিল।

২০২১ সালে আরও পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়েছিল নিউ স্টার্ট চুক্তি। ভাষণে রুশ পারমাণবিক শক্তি সংস্থা রোসাটমকে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা ফের শুরুর জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুতিন।

তবে এই দফায় রুশ প্রেসিডেন্টকে উত্তেজনা বাড়ানোর দায়ে তিরস্কার না করে উল্টো চীন তার শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই’কে রাশিয়ায় পাঠায়। শিগগির চীনা প্রেসিডেন্টও মস্কো সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে।

পুতিন বলেছেন, ‘আমরা চীনা প্রেসিডেন্টের রাশিয়া সফরের জন্য অপেক্ষা করছি। এ বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। সব কিছুই এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা নতুন সীমানায় পৌঁছাচ্ছি।’

বদলাতে পারে বৈশ্বিক সম্পর্ক
রাশিয়ার প্রয়োজনের সময়ে চীন পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তে আমূল বদলে যেতে পারে বৈশ্বিক সম্পর্কের ধরন। রাশিয়া এখন পর্যন্ত নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন করছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনকে বিপুল অস্ত্র সহায়তা পাঠিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।

এখন চীন যদি রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে ওঠে, তাহলে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হবে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যুদ্ধরত দুটি বিপরীত পক্ষকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। এটি চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প পরাশক্তির মর্যাদায় উন্নীত করতে পারে, তবে তাতে হয়তো রাশিয়ার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে।

সূত্র: আল-জাজিরা

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com