দুর্নীতিই ব্যাংক খাতের সংকটের কারণ

0

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে যে হারে ব্যাংক লুটপাট ও দখলের মহোৎসব চলছে তাতে দেশের আর্থিক ও ব্যাংক খাতে এমন বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছে যে, এর থেকে উত্তরণ কবে ঘটবে বলা যাচ্ছে না। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় সরাসরি লুটপাটের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে দেশের মানুষের ভেতর শুধু হতাশাই তৈরি হচ্ছে না, ভয়ও সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর পর্ষদে নিয়মবহির্ভূতভাবে যোগ্য পরিচালকদের সরিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যক্তিদের বসিয়ে ব্যাংক লুটপাটের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তার বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে। ব্যাংকগুলোয় তারল্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষমতাবলয়ের ব্যক্তিরা একের পর এক ব্যাংক লুট করে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করে দিচ্ছে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।

গত এক দশকে বেশ কয়েকটি ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংকে অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও অর্থ লুণ্ঠন হয়েছে। এসব কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত কিছু কর্মকর্তা পর্যায়ের ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা গেলেও মূল হোতাদের আনতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত আটটি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছে।

এ যাবৎ যত অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঋণের নামে ৩০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাটি সবচেয়ে বড়। জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে ১১টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। জামানত ছাড়া, ক্রেডিট রিপোর্ট ছাড়া, ঠিকানাহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার মানে কী দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং কয়েকজন পরিচালক এ বিপুল ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলে অভিযোগ আছে।

বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাথমিক পুঁজি গঠনে সবচেয়ে সহজ ও বহুলপ্রচলিত পদ্ধতি বোধহয় ক্ষমতার পৃষ্টপোষকতা নিয়ে এবং ব্যাংক পরিচালক এবং কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে জামানত ছাড়া বা ভুয়া জামানত দেখিয়ে ঋণ গ্রহণ করা এবং তারপর ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়া। বহু বছর সেই ঋণ শোধ না করে ঋণ পুনর্গঠনের নামে সুবিধা ভোগ করা। তা না হলে বড়জোর মামলা বা রিট হওয়া। এ মামলা বা রিটের বদৌলতে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া। এসব লুটেরা গোষ্ঠী ব্যাংক লুটপাটে বিভিন্ন কায়দা অবলম্বন করে থাকে। কখনো নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণপত্র খুলে, কখনো ভুয়া আমদানি-রপ্তানি হিসাব দেখিয়ে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ঋণের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন ব্যাংকগুলোয় জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোও এর বাইরে নয়। এসব জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদ বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা ব্যক্তিগত সুবিধার বিনিময়ে চিহ্নিত কিছু গোষ্ঠীকে নিয়মকানুন ও যাচাই-বাছাই না করেই এসব ঋণ অনুমোদন করে থাকেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির পেছনে সরকার গঠিত পরিচালনা পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বেসিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিল্প সচিবই পদাধিকার বলে এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হতেন। ব্যাংকটির পর্ষদের পরিচালকও নিয়োগ দেওয়া হতো বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের। এ ব্যবস্থায় নিয়মনীতি মেনে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক ভালোভাবেই চলছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সবকিছু যেন পালটে যায়। ২০০৯ সালে আগের নীতিমালা বদলে ব্যাংকটির পর্ষদে নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের। তারপর থেকেই এ ব্যাংকটির অবনতি ঘটতে থাকে। শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে চেয়ারম্যান পদে বসানোর পর থেকে শুরু হয় নানাভাবে বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ। সবার চোখের সামনে সবকিছু ঘটলেও বেসিক ব্যাংকের লুটপাট ঠেকাতে পারেনি কেউ। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে থাকার সময়েই শেখ আব্দুল হাই ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে দেড় বিঘা জমির ওপর একটি বাড়ি কিনেছিলেন। এত বড় অঙ্কের টাকা কীভাবে তার অ্যাকাউন্টে এসেছিল সে বিষয়ে দুদককে তখন জানানোও হয়েছিল। বেসিক ব্যাংকের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদক ২০১৫ সালে শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৫৬টি মামলা করলেও শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে কোনো মামলায় আসামি করা হয়নি। এত বড় দুর্নীতিতে জড়িত থাকা সত্ত্বেও আব্দুল হাই বাচ্চু বর্তমানে পৃষ্টপোষকদের বদৌলতে বহাল তবিয়তে বিদেশে অবস্থান করছেন।

দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকায়। শুধু এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই খেলাপি ঋণ ২১ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা বেড়েছে। একদিকে ব্যাংক দখল, অপরদিকে কিছু রাজনীতিক ও তাদের দোসরদের দ্বারা নিত্যনতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে ধনকুবের বানানোর যে অশুভ কর্মকাণ্ড চলছে তাতে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নীতি ও আদর্শহীন কিছু ব্যক্তির হাতে যেন বন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের লুটপাটে ব্যাংকগুলোর এমন করুণ দশা হয়েছে যে, গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতেও সমস্যায় পড়ছে কোনো কোনো ব্যাংক। ব্যাংকে তারল্য সংকট নেই বলে আমরা প্রায়ই উচ্চপর্যায় থেকে শুনে থাকি। অথচ কিছু কিছু ব্যাংক এমন তারল্য সংকটে পড়েছে যে, কোনো কোনো গ্রাহককে একসঙ্গে ২৫ লাখ টাকা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাংকে ডলারের অভাবের কথা কারও অজানা নয়। ডলারের অভাবে আমদানি কমানোর পরও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। অনেক ব্যাংকই ডলারের অভাবে এলসি খোলা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছে।

ব্যাংকের অর্থ লুটপাট ও আত্মসাৎ নিয়ে দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষকরা যেমন প্রায়ই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তেমনি সাধারণ মানুষও এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন। অব্যাহত দুর্নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। একের পর এক লুটেরাগোষ্ঠী ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ লুট করে দেশ-বিদেশে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে, আর দফায় দফায় সেই ব্যাংকগুলোর ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে জনগণের অর্থে গঠিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, রিজার্ভ চুরি, খেলাপি ঋণ ও দুর্নীতি-কোনো কিছুই যেন বন্ধ করা যাচ্ছে না। এগুলো উদ্ধারে কার্যকর কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না। প্রশ্ন হলো, আর কতকাল এসবের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে? এমন একটি দেশের জন্যই কি এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল? লাখ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ দেশ ও দেশের মানুষ দুর্নীতিবাজদের রাহুগ্রাস থেকে কবে মুক্তি পাবে? কবে মানুষ দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ পাবে?

সূত্র: যুগান্তর

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com