সুশাসনের অভাবে বিদ্যুৎ সুলভে পাচ্ছে না মানুষ: সিপিডি
উৎপাদন করেও সুশাসনের অভাবে মানুষের কাছে সুলভ মূল্যে বিদ্যুৎ পৌঁছানো যাচ্ছে না। অন্য দিকে ক্রমান্বয়ে বিরাট অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। জ্বালানির ভুল ব্যবহার মূল্য বাড়াতে পারে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এ সম্পর্কিত সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, জ্বালানি খাতে সরকারের ঘোষিত বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ভর্তুকি কমানো সম্ভব। এতে তিন বছরে প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা যাবে। এর জন্য একই পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। তবে এ বিনিয়োগ আসবে বেসরকারি খাত থেকে এবং যার অধিকাংশই বিদেশী বিনিয়োগ। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশে জ্বালানির ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। অন্যান্য বড় লক্ষ্যমাত্রার মতোই এটিও একটা অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে ‘খসড়া সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) : পরিচ্ছন্ন জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কি?’-শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। ব্রিফিংয়ে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইন সংশোধন করায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নখদন্তহীন হয়ে পড়েছে। জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার হস্তক্ষেপ করবে। আইন আবার সংশোধন করে বিইআরসির হাতে মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া উচিত। মহাপরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে কাঠামো, জ্বালানি নিরাপত্তা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জ্বালানি রূপান্তর, বিনিয়োগ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে সিপিডি। কিন্তু সরকারের তৈরি করা বর্তমান খসড়ায় আর্থিক বিষয়টি ওইভাবে রাখা হয়নি। জ্বালানির মূল্য নিয়েও এতে বিশদ আলোচনা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার আগামী জুনের মধ্যে ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের কথা বলেছে। কয়লা থেকেও সরে আসার কথা বলেছে। একই সাথে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হবে। আর সরকার চাইলে সাশ্রয় থেকেও বিনিয়োগ করতে পারবে। আর এসব বিনিয়োগ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পাওয়া যাবে জাননো হয়। ভর্তুকির বিষয়টিও মহাপরিকল্পনার খসড়ায় নেই। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি প্রত্যাহারের বিষয়টি সমর্থন করা যায় না। বরং দক্ষ জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে এটি করা যেতে পারে। উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দ্রুত অবসায়ন করা দরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ আইন দ্রুত অবসায়ন করা দরকার। এতে প্রতিযোগিতা নষ্ট হচ্ছে। সরকার কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়ার সুযোগ হারাচ্ছে।
প্রতিবেদন বলছে, মহাপরিকল্পনার খসড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসকে গুরুত্ব দেয়া হলেও তা অনেকটাই এলএনজিনির্ভর। আমদানি বাড়াতে অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যার জন্য বিপুল বিনিয়োগ লাগবে। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের অতিরিক্ত সক্ষমতা এখন প্রায় ৬০ শতাংশ। মহাপরিকল্পনার খসড়া অনুসারে ২০৩০ সালে এটি কমে দাঁড়াবে ৩০ শতাংশে। এটি করতে পারলে ক্যাপাসিটি চার্জ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। অতিরিক্ত সক্ষমতা আরো কমানো দরকার।
সিপিডি বলছে, ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে বলে ধরা হয়েছে মহাপরিকল্পনায়। এ হিসাবে ওই সময় মাথাপিছু আয় হতে হবে অন্তত সাড়ে ১২ হাজার ডলার। এমন উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য রাজনৈতিক হতে পারে, এ থেকে সরকারের সরে আসা দরকার। আসলে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে মহাপরিকল্পনা করা উচিত নয়, মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য থাকা দরকার। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে বিদ্যুৎ চাহিদা হিসাব করার বিষয়টিও উচ্চাভিলাষী। ২০৫০ সালে ৯০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা হিসাব করা হয়েছে। এই লক্ষ্যের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করা সম্ভব হবে না; বরং বাস্তবিক হিসাব করলে চাহিদা আরো কমবে।
উপস্থাপনায় ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এই প্রথমবারের মতো সমন্বিত জ্বালানি নীতি হতে যাচ্ছে। এর আগেও ছিল, সেগুলো আলাদা আলাদা। সেখানেও বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনার কথা বলা হলেও জ্বালানির কথাগুলো এসেছিল। আর এবার ঘোষণা দিয়ে সমন্বিত জ্বালানি নীতিমালার কথা বলা হচ্ছে। এবারের লক্ষ্য হলো সবগুলো খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় জ্বালানি খাতে আমরা পিছিয়ে আছি। আইইপিএমপি-এ নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়টি উপেক্ষিত হয়নি, তবে অবহেলিত হয়েছে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন যেভাবে চিন্তা করা দরকার সেটি পর্যাপ্ত হয়নি। ডকুমেন্টটি এখন পর্যন্ত যেভাবে রয়েছে প্রকারান্তরে তা এলএনজিকে উৎসাহিত করছে। ক্ষেত্রবিশেষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেও উৎসাহিত করছে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে জ্বালানি খাতে বেশ কিছু বড় ধরনের মিসম্যাস দেখা যাচ্ছে। এটিকে ঘাটতি বা পার্থক্যও বলতে পারি। বিদ্যুৎ খাতে এই মুহূর্তে শীতকালীন চাহিদা হলো ১২ হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ১০ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট। এখানে একটা ঘাটতি রয়েছে। তারপরেও বলতে হবে যে অতিরিক্ত রিজার্র্ভ রয়েছে। এই বাড়তি বিদ্যুতের পরিমাণ হলো ৬০ শতাংশ। ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ অব্যবহৃত আছে। তিনি বলেন, আগামী বছরের জন্য ইতোমধ্যে যে জ্বালানি সরবরাহের ঘোষণা রয়েছে সেটি স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন কম। স্বাভাবিক সময়ে ডিজেল আমদানি করা হয় ৬৪ লাখ মেট্রিক টন। আগামী বছরের জন্য ঘোষিত হয়েছে ৫২ লাখ মেট্রিক টন। প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন কম। অন্য দিকে গ্যাসের ক্ষেত্রে একই সমস্যা। সাড়ে তিন হাজার এমএমসিএফটি দরকার প্রতি মাসে, সেখানে আমরা দুই হাজার ৮২৮ এমএমসিএফটি পাচ্ছি গত বছরের গড় হিসাবে। এখানেও গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে একটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। গ্যাসের ঘাটতি মূলত এলএনজি দিয়ে পূরণ করা হয়। সামগ্রিকভাবে জ্বালানি ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে একটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, লক্ষ্যমাত্রাটা একটা স্লোগানের মতো। কপ-২৬-এর আগে বিভিন্ন দেশ ঘোষণা করেছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা, সেই তালেই কি আমরা বলেছি? নাকি বাস্তবতার প্রেক্ষিতে? আমাদের এখন পর্যন্ত যে অর্জন, ২০৪০ সালে সেই লক্ষ্যমাত্রায় আমরা যেতে পারবো কি? তবে একটি কথা আছে এখানে, প্রযুক্তি ও অর্থায়নের প্রয়োজন আছে। সেটি থাকলে আমরা ত্বরান্বিত করতে পারব। আগে যে হারে যাচ্ছি সে হারে না, এটাকে আরো উল্লম্ফন দিয়ে যেতে হবে। এখানে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ নেয়ার প্রয়োজন পড়বে।
তিনি বলেন, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনকে মাথায় রেখে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাচ্ছি। সেখানে যে ধরনের প্রযুক্তির কথা বলা হচ্ছে, অনেক দেশ এগুলো বাদ দিয়ে যাচ্ছে। কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ, অনেকে এটা এখন আর ব্যবহার করছে না। এটা বর্জন করছে। এটার ব্যবহারে প্রচুর অর্থ এবং জায়গার প্রয়োজন পড়ে। সেখানে যে বিনিয়োগ হয় সেটি কস্ট ইফেকটিভ হয় না। তিনি বলেন, আমরা যেটা উৎপাদন করব সেটি কস্ট ইফেকটিভ না হলে আমরা সেটি করব না। যেটা বর্জন হয়ে আছে উন্নত দেশে, সেগুলো আমরা করব না।
আইইপিএমপি প্রসঙ্গে ড. ফাহমিদা বলেন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এমন একটা খাত, এখানে অনেকেরই স্বার্থ রয়েছে। এই স্বার্থ দেশের ভেতরের এবং বাইরেরও। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৌশলগত উপাদান। বাইরের স্বার্থকে পেছনে ফেলে দেশের স্বার্থটা কী হবে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত।
সিপিডির এই কর্মকর্তা বলেন, সুশাসনের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও গ্রিডে দিতে পারছি না। মানুষের কাছে সুলভ মূল্যে পৌঁছে দিতে পারছি না। অন্য দিকে ক্রমান্বয়ে বিরাট অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছি, যাদের ভর্তুকির দরকার নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যেও বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, এমন একটা কঠিন সময়ে যখন মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে, যখন মূল্য যৌক্তিকীকরণের কথা বলি, তখন সেটি সাধারণ মানুষের ওপর এসে পৌঁছায়। যেখানে সুশাসন দিয়ে বড় রকমের সাশ্রয় করতে পারি, আধুনিক টেকসই জ্বালানি খাত তৈরি করতে পারি। সেটির দিকে নজর দেয়া উচিত।