শিবসেনা ভাঙনের মূলে কি ‘হিন্দুত্ব’ ইস্যু

0

ভারতের মহারাষ্ট্রে অর্ধশতাব্দীরও বেশি পুরনো হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনা তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে।

শিবসেনার প্রথম সারির নেতা একনাথ সিন্ধে দলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বিধায়ককে নিয়ে বিদ্রোহ করার পর মহারাষ্ট্রে শিবসেনার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার টিঁকবে কি না তা নিয়ে প্রবল সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

বিদ্রোহী গোষ্ঠী বলছে, উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বে শিবসেনা হিন্দুত্বের চিরাচরিত পথ থেকে সরে এসেছে বলেই তারা মনে করছেন। দলকে হিন্দুত্বের পথে ফেরাতে তারা ফের বিজেপির সঙ্গে জোট করার পক্ষেও অভিমত ব্যক্ত করছেন।

মুখ্যমন্ত্রী ও শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরে বুধবার রাতেই মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছেড়ে তাদের পারিবারিক বাসভবন ‘মাতোশ্রী’তে চলে গিয়েছেন, যেখানে দলের প্রতিষ্ঠাতা ও তার পিতা পরলোকগত বালাসাহেব ঠাকরে থাকতেন।

তবে ঠাকরে পরিবার আদৌ শিবসেনার ওপর তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারবে কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়, দল হিসেবে শিবসেনার ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়েও রয়েছে প্রবল অনিশ্চয়তা।

শিবসেনার রাজনীতি
১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি মারাঠি উপ-জাতীয়তাবাদ (সাব-ন্যাশনালিজম) আর উগ্র হিন্দুত্বের ওপর ভর করে মুম্বাইতে শিবসেনা দলটির জন্ম দেন বালাসাহেব ঠাকরে- যিনি পেশায় ছিলেন কার্টুনিস্ট ও রাজনৈতিক স্যাটায়ারিস্ট।

মুম্বাইয়ের প্রবীণ সাংবাদিক হরিশ নাম্বিয়ারের মতে, আসলে শিবসেনা আগাগোড়াই ছিল আঞ্চলিকতাবাদ ও মৌলবাদে পুষ্ট একটি দল।

তিনি বলেন, ‘শিবসৈনিকরা প্রথম দিকে আক্রমণ চালাত মুম্বাইয়ে দক্ষিণ ভারতীয়দের ক্যাফে, দোকানপাট বা কলোনিতে। আর সেটায় উসকানি দিতে বাল ঠাকরে নিজের ম্যাগাজিনে দক্ষিণ ভারতীয়দের নাম-ঠিকানা টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে হুবহু টুকে দিতেন।’

তিনি বলেন, “পরে ‘বহিরাগত’ দক্ষিণ ভারতীয়দের ছেড়ে তারা আক্রমণের নিশানা করে মুম্বাইয়ের মুসলিমদের।”

‘আর সেই মুসলিম-বিরোধিতাই বছরের পর বছর ধরে শিবসেনার রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে থেকে গেছে,’ বিবিসিকে বলছিলেন নাম্বিয়ার।

পাকিস্তান-ভারত ম্যাচের আগে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পিচ খুঁড়ে খেলা বানচাল করাই হোক কিংবা রামমন্দির আন্দোলনে সক্রিয় যোগদান- এগুলোই ছিল বাকি দেশে শিবসেনার পরিচিতি।

দেশের জাতীয় স্তরের হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির সাথে তাদের সমঝোতাও ছিল বহু বছর ধরে।

বছর তিনেক আগে মহারাষ্ট্রে ভোটের পর শিবসেনা যখন শারদ পাওয়ারের এনসিপি আর কংগ্রেসের সাথে মিলে ‘মহা আগাডি’ জোট সরকার গঠন করে, তখনই ভেঙে যায় সেই সমঝোতা।

কে এই একনাথ সিন্ধে?
এখন সেই ‘মহা আগাডি’ জোট গঠনের বিরোধিতা করেই দলের বেশির ভাগ এমএলএ-কে সাথে নিয়ে বিদ্রোহ করেছেন শিবসেনার অন্যতম প্রধান নেতা ও রাজ্যের সিনিয়র মন্ত্রী একনাথ সিন্ধে।

বিবিসি মারাঠি বিভাগের সম্পাদক আশিস দীক্ষিত বলছিলেন, ‘একনাথ সিন্ধে হলেন ঠাকরে পরিবারের বাইরে শিবসেনার সবচেয়ে বড় নেতা। শীর্ষে উদ্ধব ঠাকরে, তারপর তার ছেলে ও তরুণ নেতা আদিত্য ঠাকরে আর তিন নম্বরেই একনাথ।’

তিনি বলেন, ‘দলে তার নিজস্ব গোষ্ঠীও আছে, সব সময় তিনি দশ-পনেরো জন বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন- যেটা শিবসেনার আর কোনও নেতা করেন না।’

তিনি বলেন, ‘মুম্বাইয়ের কাছে থানে অঞ্চল থেকে উঠে আসা এই রাজনীতিবিদ একসময় অটোচালক ছিলেন, এবং প্রয়াত শিবসেনা নেতা আনন্দ দীঘে-ই তাকে গড়েপিটে তৈরি করেছিলেন। আনন্দ দীঘেই তাকে প্রথম বালাসাহেবের কাছে নিয়ে যান।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু নানা কারণে এই প্রভাবশালী নেতা যে উদ্ধব ও অদিত্য ঠাকরের ওপর অসন্তুষ্ট এটা অজানা ছিল না, যেটাকে বলা যেতে পারে দলের পুরনো ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিরোধ।’

‘কংগ্রেসে যেমন সোনিয়া গান্ধীর অনুগামীরা অনেকেই আজও রাহুল গান্ধীকে মেনে নিতে পারছেন না, শিবসেনাতেও ঠিক একই জিনিস ঘটছিল,’ বলছিলেন আশিস দীক্ষিত।

হিন্দুত্ব অ্যাজেন্ডা দুর্বল হচ্ছিল?
বিদ্রোহের কারণ হিসেবে একনাথ সিন্ধে টুইটারে জানিয়েছেন, হিন্দুত্বের পথ থেকে সরে এসে শিবসেনা এনসিপি বা কংগ্রেসের মতো ‘আন-ন্যাচারাল’ বা অস্বাভাবিক শরিকদের সঙ্গে হাত মেলাবে বালাসাহেবের শিষ্য হিসেবে এটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না।

যার জবাবে বুধবার সন্ধ্যায় উদ্ধব ঠাকরে ফেসবুক লাইভে তার আবেগী ভাষণে বারবার বলতে চেয়েছেন, ‘শিবসেনা ও হিন্দুত্ব সমার্থক!’

তার দল কখনো হিন্দু ভাবাবেগের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি বলেও ওই ভাষণে বারবার দাবি করেছেন উদ্ধব।

বুধবার রাতে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ‘বর্ষা’ থেকে মালপত্র নিয়ে যখন তিনি ‘মাতোশ্রী’তে ফিরে আসছেন, হাজার হাজার শিবসৈনিক তার কনভয়কে ঘিরে ধরে আবেগে ভেসেছেন।

কিন্তু উদ্ধব এরপরেও দলের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবেন, এটা সহজে বলা যাচ্ছে না।

পর্যবেক্ষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শিবসেনা মহারাষ্ট্রের বিগত নির্বাচনে বিজেপির সাথে নির্বাচনী সমঝোতা করেই ভোটে লড়েছিল। ফলে এখন যারা শিবসেনার বিধায়ক, তাদের জেতার পেছনে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভোটারদেরও সমর্থন ছিল অনেকটাই।

এখন পরবর্তী ভোট যত এগিয়ে আসছে, এই বিধায়করা অনেকেই নিশ্চিত নন, বিজেপির সাহায্য ছাড়া তারা আবার জিতে আসতে পারবেন কি না।

শিবসেনাকে হিন্দুত্বের এজেন্ডায় ফেরাতেই- বা অন্যভাবে বললে দলকে আবার বিজেপির হাত ধরাতেই- এই ‘বিদ্রোহে’র অবতারণা, বিষয়টাকে সেভাবেও ব্যাখ্যা করছেন অনেক বিশ্লেষক।

‘রিমোট কন্ট্রোল’ পরম্পরায় ভাঙন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্বাতী চতুর্বেদী বিবিসিকে বলছিলেন, ‘উদ্ধবকে তার বাবা বাল ঠাকরে দলটা প্লেটে করে সাজিয়ে হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আর আজ কিন্তু তাকে শুধু মুখ্যমন্ত্রীর পদ নয়, সেই দলটা বাঁচাতেও লড়তে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, শিবসেনাতে আগেও বিদ্রোহ হয়েছে, ছগন ভুজবল, নারায়ণ রানে এমনকি বাল ঠাকরের প্রিয়পাত্র ও উদ্ধবের ভাইপো রাজ ঠাকরেও দল ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন- কিন্তু মনে রাখতে হবে একনাথ সিন্ধে এদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী নেতা।’

‘আসলে সমস্যাটা হল, বাল ঠাকরে সরকার থেকে দূরে থাকতেন, নিজেই বলতেন আমি রিমোট কন্ট্রোলে সব চালাই – আর সেখানে উদ্ধব ও তার ছেলে নিজেরা সরকার চালাতে গিয়েই বিপদে পড়েছেন,’ বলছেন চতুর্বেদী।

বস্তুত শিবসেনা এর আগেও বহু বছর মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায় থেকেছে, মুম্বাইয়ে পৌরসভা চালিয়েছে- কিন্তু বাল ঠাকরে নিজে বা তার পরিবারের কেউ কখনো মুখ্যমন্ত্রী বা মুম্বাইয়ের মেয়রের পদে বসার আগ্রহ দেখাননি।

বাল ঠাকরে ‘মাতোশ্রী’ থেকেই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে ভালোবাসতেন, মনোহর জোশী বা নারায়ণ রানের মতো শিবসেনার মুখ্যমন্ত্রীরা তার বাড়িতে এসেই সব কিছু ‘রিপোর্ট’ করে যেতেন।

এই ট্র্যাডিশন বদলে যায় বছর তিনেক আগে, যখন উদ্ধব ঠাকরে নিজে জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং তাঁর ছেলে আদিত্যকেও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন।

আসল ক্ষমতার রাশ ‘মাতোশ্রী’তে থাকলেও শিবসেনার অন্য নেতাদের এর ফলে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যে সম্ভাবনা থাকত- সেটাও এর ফলে চুরমার হয়ে যায়।

একনাথ সিন্ধের বিদ্রোহের পেছনে অনেকে এই কারণটাকেও দায়ী করছেন।

আদিত্যর উত্থানে শঙ্কা
মুম্বাইয়ের রাজনৈতিক ভাষ্যকার সঞ্জয় ঝা-রও ধারণা, শিবসেনায় যেভাবে আদিত্য ঠাকরেকে তুলে আনা হচ্ছিল তাতে একনাথের মতো প্রবীণ নেতারা হয়তো মনে করছিলেন তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার- কখনোই তাদের আর শীর্ষ পদে যাওয়া হবে না।

তিনি বলেন, ‘সরকারে ও ক্যাবিনেটে যেভাবে আদিত্য ঠাকরে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছিলেন ও তাকে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হচ্ছিল তাতে এটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠছিল যে উদ্ধব ঠাকরের পর মুখ্যমন্ত্রী পদে আদিত্যই শিবসেনার মুখ।’

তিনি বলেন, ‘দলের সিনিয়র নেতারা, যারা পরলোকগত বালাসাহেবকেই এখনো নিজেদের নেতা বলে মানেন ও তার দেখানো রাস্তাতেই চলতে পছন্দ করেন, তারা এটাকে খুব ভালভাবে নিতে পারেননি বলাই বাহুল্য!’

‘হিন্দুত্বের সঙ্গে আপস নিয়েও শিবসৈনিকরা অনেকে মন:ক্ষুণ্ণ ছিলেন, ফলে দলের ভেতরে একটা ফল্টলাইন কিন্তু তৈরি হয়েই ছিল’, বলছিলেন ঝা।

বিদ্রোহে বিজেপির হাত কতটা?

আর বহু বছর ধরে শিবসেনার সাথে ঘর-করা বিজেপি এই পরিস্থিতিটারই সুযোগ নিয়েছে পুরো মাত্রায়।

সঞ্জয় ঝা এবং তার মতো আরো বহু পর্যবেক্ষকই নিশ্চিত, শিবসেনার ভেতরে এই বিদ্রোহে বিজেপি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে।

একনাথ সিন্ধে ও তার অনুগামীরা যেভাবে প্রথমে বিজেপি-শাসিত গুজরাটের সুরাটে একটি পাঁচতারা হোটেলে গিয়ে ওঠেন এবং সেখান থেকে মধ্যরাতের ফ্লাইটে আর একটি বিজেপি-শাসিত রাজ্য আসামে উড়ে যান- বিজেপি সরকারগুলোর সাহায্য ছাড়া তা কিছুতেই সম্ভব ছিল না।

আসামের গুয়াহাটিতে যে র‍্যাডিসন ব্লু হোটেলে একনাথ সিন্ধে ও তার শিবিরের বিধায়করা এখন রয়েছেন, রাজ্যের বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা সেখানে গিয়েও তাদের সাথে দেখা করে আসছেন।

এখন একনাথ সিন্ধে যদি নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রমাণ করতে পারেন, দলের বেশির ভাগ এমএলএ-এমপি বা জনপ্রতিনিধি তার সাথেই আছেন, তাহলে আসল ‘শিবসেনা’র স্বীকৃতির পাশাপাশি দলের নির্বাচনী প্রতীক তীর-ধনুকও তার কাছেই আসবে।

বিজেপি সে প্রক্রিয়াতেও তাদের সাহায্য করবে অবধারিতভাবে- আর সে ক্ষেত্রে ছাপ্পান্ন বছরেরও বেশি সময় পর শিবসেনার ‘দখল’ হারাবে ঠাকরে পরিবার।
সূত্র : বিবিসি

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com