বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে
প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও তাদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পুরো প্রক্রিয়ায় সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করছে টিআইবি। এ অবস্থায় বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে দশ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহের পর বিশ্লেষণ করে গুণগত পদ্ধতিতে গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়।
গবেষণার ফল থেকে দেখা যায়, বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রাপ্তির প্রক্রিয়া যেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক সেখানে পরিকল্পনাহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, কাঠামোগত জটিলতা, অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ, জবাবদিহি ব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সামাজিক সচেতনতা ও সংবেদনশীলতার ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বীরাঙ্গনারা এখনো প্রান্তিকীকরণের শিকার। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি ও নারী বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমের নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক কাজ থাকলেও তা নারী বিষয়ক অন্য যেকোন কাজের তুলনায় অপ্রতুল।
টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়, গেজেটভুক্তির আবেদন হতে শুরু করে গেজেটভুক্তির জন্য সর্বোচ্চ কতদিনে মধ্যে কার্যক্রম নিষ্পত্তি করতে হবে তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা আইনে বা বিধিতে উল্লেখ নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। এছাড়া, আবেদন প্রাপ্তির তারিখ হতে পরবর্তী ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে আবেদনটি নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা থাকলেও ভাতা পেতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩-৬ মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। অন্যদিকে ‘বীর নিবাস’-এর ঘরের জন্য আবেদন করার ছয় বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও ঘর না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার, এই ঘর পাওয়ার জন্য ন্যূনতম জমির মালিকানার শর্ত দরিদ্র ও ভূমিহীন বীরাঙ্গনাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ে বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করার বা চিহ্নিত করার কোনো পরিকল্পনা নেই। সংবেদনশীলতা রক্ষার স্বার্থে বীরাঙ্গনা হিসেবে শুধু যারা স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবেন তাদের গেজেটভুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। সুনির্দিষ্ট কাঠামো না থাকার কারণে গেজেটভুক্তির জন্য সরকারের এই আহ্বান অনেকক্ষেত্রে প্রকৃত সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছায় না। ফলে এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ৪৪৮ জন বীরাঙ্গনার মধ্যে ৪৩৩ জন জীবিত অবস্থায় নিজেদের পক্ষে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এছাড়াও ১৫ জন বীরাঙ্গনার মৃত্যুর পর তাদের পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রতিনিধি হয়ে নাম তালিকাভুক্ত করেছেন।
বীরাঙ্গনা বা মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্তির প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য উপজেলা পর্যায়ে বিশেষ কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত পদ নেই। উল্টোদিকে অধিকাংশ বীরাঙ্গনা শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘাটতি এবং বয়সের কারণে গেজেটভুক্তির জন্য নির্ধারিত কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পাদন করতে জটিলতার সম্মুখীন হন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এমআইএস-এ তথ্যের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী এখন পর্যন্ত গেজেটভুক্ত মোট বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা যেখানে ৪৪৮ জন সেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এমআইএস-এ এন্ট্রি রয়েছেন ৪০২ জন। এছাড়া সরকারি বা স্থানীয় পর্যায়ে কোনো তালিকা না থাকা এবং পারিবারিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাপে পরিচয় গোপনের কারণে বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করা প্রথম ও বড় চ্যালেঞ্জ। গেজেটভুক্তির বিভিন্ন ধাপে বেশিরভাগ আবেদনকারী বীরাঙ্গনা নানা পক্ষ হতে বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার।
গেজেটভুক্তির প্রক্রিয়ায় অন্যতম জটিলতা হচ্ছে যাচাই-বাছাই কমিটির সামনে নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করা, যা কোনোভাবেই সংবেদনশীল নয়। এছাড়া বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি প্রদানের এই প্রক্রিয়ায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের কারণে সৃষ্ট নেতিবাচক মনোভাব থেকে বীরাঙ্গনা, তাদের পরিবার-পরিজন সর্বোপরি সাধারণ মানুষদের উত্তরণের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেই।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার নিশ্চিতকরণে একদিকে পর্যাপ্ত সরকারি প্রাধান্যের ঘাটতি ও অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধারা প্রান্তিকীকরণের শিকার। বীরাঙ্গনা মুক্তিযুদ্ধাদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পুরো প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার প্রাপ্তির এই সংবেদনশীল বিষয়টি যেখানে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক, সেখানে পরিকল্পনাহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, কাঠামোগত জটিলতা, আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি নির্ভরতা, অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ, জবাবদিহি ব্যবস্থা ও সংবেদনশীলতায় ঘাটতি প্রক্রিয়াটিকে বীরাঙ্গনা মুক্তিযুদ্ধাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই হয়রানি ও হতাশাব্যঞ্জক করে তুলেছে।