‘আবারও ব্যাংক খাতে ৪ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি শনাক্ত’
ব্যাংক খাতে দুর্নীতি থেমে নেই। এবারও ৪ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি উঠে এসেছে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) প্রতিবেদনে।
আর্থিক খাতের দুর্বৃত্তরা নানা কৌশলে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা বের করে নিয়েছে। বিশেষ করে ঋণখেলাপি হয়ে এবং খাস জমি মর্টগেজ রেখে ঋণ নিয়ে গেছে।
অস্তিত্ব ও যোগ্যতাহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ঘটনা আছে। ভুয়া বন্ধকি নিয়েও ঋণ ইস্যুর ঘটনা ঘটেছে। এভাবেই ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম হয়েছে।
সিএজির প্রতিবেদন খুব শিগগিরই হস্তান্তর করা হবে রাষ্ট্রপতির কাছে। এরপর তা উপস্থাপন করা হবে জাতীয় সংসদে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বিগত কয়েক বছরের ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জড়িত অনেকে এখন জেল খাটছে। এরপরও সিএজির প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম উঠে আসছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আরও কঠোর হতে হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক ডিজিএম কে মুজেরি বলেন, কোনো অনিয়মই গ্রহণযোগ্য নয়।
যে খাতে যত বেশি অনিয়ম সে খাতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা তত বেশি। ব্যাংকিং খাতে আর্থিক অনিয়ম প্রমাণ মিলছে এ খাতের দুর্বলতার।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বিগত সময়ে ব্যাংকিং খাতে অনেক সংস্কার করেছে। কিন্তু বাস্তবে এখনো অনেক দুর্বলতা রয়েছে।
আগামী দিনের লক্ষ্য অর্জনে এটি বড় বাধা। তিনি বলেন, আর্থিক খাতের অনিয়ম শেষ পর্যন্ত প্রকৃত খাতেও এর প্রতিফলন ঘটে। এখন দুর্বলতার কারণ চিহ্নিত এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক আরও সংস্কার করতে হবে।
সূত্র জানায়, প্রতিবছর সরকারের বাজেটের টাকা ব্যয়ের ওপর সিএজি নিরীক্ষা করে। পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের ওপর বিশেষভাবে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা হয়। কারণ কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে বড় অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে এ খাত ঘিরে।
সিএজি হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির অঙ্ক ছিল ৬৫২ কোটি টাকা। নিরীক্ষা বিভাগই তা শনাক্ত করে।
আর সর্বশেষ ২০২০ সালে যে রিপোর্ট তৈরি করেছে সেখানে ৪ হাজার কোটি টাকার অনিয়মের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে। এর আগের বছর ব্যাংকিং খাতে অনিয়মের অঙ্ক ছিল ১০ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা।
তবে অনিয়ম হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, এরপর খোলা ছিল সীমিত পরিসরে। ওই সময়ে ব্যাঘাত ঘটেছে সিএজির নিরীক্ষা কার্যক্রমে। মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা সম্ভব হয়নি। ফলে এ ব্যবধান দাঁড়াতে পারে।
সিএজির প্রতিবেদনে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ১৬৯৯ কোটি টাকার অনিয়ম শনাক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া রূপালী ব্যাংকের ৯৩৪ কোটি টাকার অনিয়ম নিয়ে বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য ব্যাংকের অনিয়ম চিহ্নিত হয় আরও ১২৩৫ কোটি টাকার। অনিয়মের কারণ হিসেবে ঋণ বিতরণ নীতিমালা অনুসরণ না করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন বিভ্রান্তিকে দায়ী করা হয়।
এছাড়া আর্থিক বিধিবিধান ও সরকারের বিভিন্ন সময়ে আদেশ অমান্য, ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও নিরীক্ষা কার্যক্রম দুর্বল থাকার বিষয়টি কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়।
সূত্রমতে, সিএজি এবার রূপালী ব্যাংকের অনিয়মের ওপর বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে মেয়াদি ঋণ আদায় না করে ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে এলটিআর (লোন এগিনিণ্ট ট্রাস্ট রিসিপট বা বিশ্বাসী ঋণ) সৃষ্টি করা।
এ কারণে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ১২৮ কোটি টাকা। গ্রাহক এই টাকা ফেরত দেয়নি। এছাড়া মঞ্জুরিশর্ত লঙ্ঘন করে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের সীমারিক্ত ঋণ দেওয়া হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
এটিও শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জামানতবিহীন এলটিআর সৃষ্টি, ত্রুটিপূর্ণ রপ্তানি বিলের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া, শাখা ব্যবস্থাপনার যোগসাজশে এসএমই ঋণ দেওয়া হয়েছে।
একটি ঘটনায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়া, ওই টাকা নিয়ে আংশিক চালুর পর রুগ্ণ হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি জালিয়াতি ও নিকাশের (ক্লিয়ারিং) মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, শর্ত অনুযায়ী ঋণ সমন্বয় না করায় খেলাপি হওয়াসহ আরও একাধিক ঘটনায় ব্যাংকের ১৪২ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে।
রূপালী ব্যাংক ছাড়াও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ওপর নিরীক্ষায় দেখা গেছে, সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে ইনভেস্টর হিসেবে ঋণসীমার অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হয়েছে।
ফলে জামানত অপেক্ষা দায় বেশি হওয়ায় কোম্পানির হিসাব রুগ্ণ হয়ে পড়ে। এতে আইসিবির ২১০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। এছাড়া ১৮২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে আইসিবি সিকিউরিটিজ কোম্পানি লিমিটেডকে।
কিন্তু সে ঋণ ফেরত আসেনি। আরও একটি বড় অনিয়ম ধরা পড়ে ২৭৬ কোটি টাকার। অস্বাভাবিকভাবে ইনভেস্টর মার্জিন ঋণ লেনদেনের মাধ্যমে এ অনিয়ম হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সীমার অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ঋণের টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি বড় ব্যাংকে অনিয়মের অঙ্ক ৭৩৮ কোটি টাকা শনাক্ত হয়েছে। অনিয়মের ধরন থেকে জানা গেছে, একই মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান একে অপরের ওপর ঋণপত্র স্থাপন দেখিয়ে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া অপর একটি ঘটনায় আরও ১০৮ কোটি টাকার অনিয়ম শনাক্ত হয়।
এছাড়া ভুয়া রপ্তানি বিল, এলটিআর ঋণের বিশ্বাসভঙ্গ, ঋণের টাকা নিয়ে ব্যবসা বন্ধসহ নানাভাবে প্রায় ৫শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। উল্লিখিত ছাড়া আরও নানা ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে বড় অঙ্কের তছরুপ হয়েছে ব্যাংকটিতে।
ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, দুর্নীতি এতটাই বিস্তৃত যে, এর বাইরে থেকে কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না।
এটা নিচ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যাংক পরিচালনার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। যারা ঋণ নেন, তাদেরও অনেকে দুর্নীতিগ্রস্ত।
এ দুই পক্ষের মধ্যে যোগসাজশ আছে। যারা ঋণ নেন, তাদের মধ্যে অনেকে এত প্রভাবশালী, তাদের কথা না শুনলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার চাকরিও যেতে পারে। কিছু কিছু ব্যাংকের মালিকপক্ষই দুর্নীতিগ্রস্ত। তারাই তাদের ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে ফেলে।