পেট্রাপোলে ‘সিন্ডিকেটে’ জিম্মি আমদানিকারকরা
বেনাপোলের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল বনগাঁ কালিতলা পার্কিংয়ে আটকা পড়েছে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা কয়েক হাজার পণ্য বোঝাই ট্রাক। দীর্ঘ দিন ধরে এসব ট্রাক থেকে সিরিয়ালের ও পার্কিংয়ের নামে চাঁদাবাজি করছে একটি সিন্ডিকেট। পণ্যবোঝাই এক একটি ট্রাক ২০দিন থেকে এক মাসেরও বেশি দিন ধরে এ পার্কিংয়ে পড়ে আছে। সেখানে চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের আমদানিকারকরা। ফলে দু’দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের ধস নামতে শুরু করেছে।
বেনাপোল বন্দরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ এ বন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ পৌরসভার মেয়র শংকর আঢ্য ডাকু। তার নিজ মালিকানাধীন কালিতলা পার্কিং। বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা ট্রাকগুলো পেট্রাপোল বন্দরের সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউজ করপোরেশনের টার্মিনালে না পাঠিয়ে ওই পাকিংয়ে পার্কিং চার্জের নামে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এতে বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে দু’দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ক্রমেই আমদানি বাণিজ্য কমে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধস নামতে শুরু করেছে।
বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, ভারতীয় কাস্টম, বন্দর ও সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো বৈঠকই ফলপ্রসূ হয়নি। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বিষয়টি ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে একাধিকবার পত্র দিয়ে জানিয়েছেন। তারপরও কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বেনাপোল বন্দর দিয়ে দুই দেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করে ট্রাক থেকে প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকার চাঁদা। চাঁদার পুরো টাকাটাই পরিশোধ করতে হয় বাংলাদেশি আমদানিকারকদের। ফলে বাংলাদেশে একটি আমদানি পণ্যবোঝাই ট্রাক প্রবেশ করতে সময় লাগছে ২০ থেকে ৩০ দিন। চাঁদা আদায়ের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ট্রাক থেকে মোটা অংকের চাঁদা আদায় ও পণ্য প্রবেশে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বড় বড় আমদানিকারকরা বেনাপোল বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ হারাচ্ছে ।
এ বন্দর দিয়ে প্রতি বছর ভারতের সঙ্গে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে বেনাপোল কাস্টম হাউস।
বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৫৫০ ট্রাক পণ্য আমদানি হতো ভারত থেকে। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০ থেকে ২৫০। পার্কিংয়ে প্রতিটি ট্রাক থেকে ডেমারেজ বাবদ দুই হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে প্রতিদিন। এছাড়া জরুরী পণ্য চালান আনার জন্য সিন্ডিকেটকে দিতে হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। বনগাঁ ও পেট্রাপোল স্থলবন্দরে সিন্ডিকেট কর্তৃক চাঁদা বাজির কারণে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের জন্য ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও তারা এ সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত হতে পারেননি। বাংলাদেশ ও ভারতীয় বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিবারই বলছে তারা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন। তবে ওপারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনৈতিকভাবে দেখা না হলে এ সমস্যার সমাধান কখনো হবে না। কারণ আদায় করা অর্থের ভাগ চলে যায় বিভিন্ন মহলে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত জুন মাসে বর্তমান মেয়র গোপাল শেঠ দায়িত্ব নেওয়ার পরও আগের মেয়রের পথেই হাঁটছেন তিনি। প্রতিদিন ট্রাক প্রতি পার্কিং খরচ নেওয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা করে। পণ্যবাহী ট্রাক পার্কিংয়ে যে কয়দিন থাকবে সে কয়দিনের টাকা ভারতের রফতানিকারকরা বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, ওখান থেকে প্রতিদিন কত ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে আমদানি করা পণ্যগুলো ক্ষতিগ্রস্ত ও হচ্ছে।
ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, বেনাপোল বন্দর দিয়ে স্থলপথে পণ্য আমদানি করতে বেনাপোলের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে একটি শক্তিশালী চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বনগাঁ পৌরসভার মেয়রের নেতৃত্বে তার লোকজন প্রতিটি পণ্যবোঝাই ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করছেন। পণ্যবোঝাই একটি ট্রাক ৩০ দিন ওপারে আটকে থাকলে তাকে ৬০ হাজার রুপী পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে আমদানিকারকরা মোটা অংকের আর্থিক লোকসানে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। বারবার বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনসহ দুদেশের বিভিন্ন মহলে জানানোর পরও বিষয়টির সুরাহা হচ্ছে না।
ভারতের পেট্রাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, বনগাঁও পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সিরিয়ালের নামে এসব ট্রাক কালিতলা পার্কিংয়ে ঢোকানো হচ্ছে। এ চাঁদাবাজি বন্ধ হলে বাংলাদেশে দ্রুত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বেনাপোল কাস্টম ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, দেশের ৭৫ ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামালের পাশাপাশি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য আসে বেনাপোল বন্দর দিয়ে। তবে আমদানিতে জটিলতার কারণে এসব পচনশীল পণ্য নষ্ট হচ্ছে এবং অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে। পণ্য আমদানিতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেক আমদানিকারক এ বন্দর ছেড়ে অন্য বন্দরমুখী হচ্ছেন।
বেনাপোল কাস্টম কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বলেন, ভারতীয় পেট্রাপোল কালিতলা পার্কিংয়ে বর্তমানে কয়েক হাজার পণ্যবোঝাই ট্রাক আটকা আছে বলে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। আমরা রাজস্ব আয় ও ট্রাক সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ভারতীয় কাস্টমস ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে যাচ্ছি।