বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে করোনায় ভোগ্য পণ্যের বাজার বেসামাল

0

দাম নিয়ন্ত্রণে চাহিদা ও সরবরাহের পরিবর্তে মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেটের প্রভাব, করোনায় উৎপাদনে সমস্যা ও হাতবদলের সময় অতিমুনাফার লোভে দেশে অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার। প্রধান খাদ্যপণ্য চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দা ইত্যাদি পণ্যের মধ্যে কোনোটির দাম আগের বছরের তুলনায় ৪২ শতাংশ পর্যন্তও বেড়েছে।
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দরিদ্র মানুষের খাবার হিসেবে পরিচিত মোটা চালের দাম। এর পরে রয়েছে ভোজ্য তেল সয়াবিন ও পাম।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারিতে শ্রমিক সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে ডাল, তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় দেশের বাজারেও তা সমন্বয় হয়েছে। ফলে দেশের বাজারেও দাম বেড়েছে।
তবে বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা মহামারির সুযোগ নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। সরকারের তদারকিও কার্যকর ছিল না। যেমন পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে দেশে পেঁয়াজের দাম সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিল, যদিও এখন কমে গেছে। ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় মোটা চালের দাম। এ দুটি পণ্যই গরিবের নিয়মিত খাবার।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে খুচরা বাজারে সরু চালের দাম ৫৮ থেকে ৬৪ টাকা কেজি। ২০১৭ সালে হাওরে বন্যার পর থেকে এর দাম সর্বোচ্চ। গত বছর এই সময়ে সরু চালের দাম ছিল ৫২ থেকে ৬০ টাকা কেজি। অর্থাৎ চলতি বছর ভোক্তাকে সরু চাল খেতে হচ্ছে কেজিপ্রতি চার থেকে ছয় টাকা বা ১১ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে। এই দাম মাসখানেক আগে আমনের ভরা মৌসুমে আরো দু-চার টাকা বেশি ছিল। সরু চালের দাম কিছুটা কমেছে আমদানির খবরে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে মোটা চালের দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪২ শতাংশ বেশি। রাজধানীর বাজারগুলোতে বর্তমানে খুচরায় মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা কেজি। গত বছর যা ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। অর্থাৎ এ বছর বেশি রয়েছে কেজিতে ১৩ থেকে ১৪ টাকা। অথচ ভারত থেকে সরকার মোটা চাল কিনছে কেজিপ্রতি ৩৪ টাকায়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বোরোতে ভালো ফলন হলেও আমনে ১৫ লাখ টন কম উৎপাদন হয়েছে। ধান-চাল সংগ্রহ করতে না পেরে সরকারের মজুদ কমে যায়। এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া গত বোরো মৌসুমে কৃষকরা তাঁদের ধান ধীরে ধীরে বিক্রি করেছেন। ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কায় মজুদ ধরে রেখেছিলেন। এ পরিস্থিতিতে সরকারও যথাসময়ে আমদানি করতে ও প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপে ব্যর্থ হয়। এসব কারণে চালের দাম বেড়েছে।
আমদানি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্য তেলের দাম। ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি শুরু হয় গত বছরের জানুয়ারি থেকে, যখন করোনার প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
বাজার তথ্যে দেখা যায়, খুচরা বাজারে ২০১৮ সালে জানুয়ারিতে খোলা সয়াবিন তেল ৮২ থেকে ৮৫ টাকা কেজি বিক্রি হলেও গত বছরের একই সময় ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা কেজি। বছর শেষে তা ১২৩ থেকে ১২৫ টাকায় ওঠে। এখন ১২২ থেকে ১২৪ টাকা কেজি। সে হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩১ শতাংশের বেশি। আর স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৪৬ শতাংশের বেশি।
বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা (অনেকে কিছুটা কমে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা বিক্রি করেন)। গত বছর একই সময় যা ছিল ১০০ থেকে ১১০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। সয়াবিনের সঙ্গে বেড়েছে পাম তেলের দাম। পাম লুজ তেল এখন ১০০ থেকে ১১২ টাকা, যা গত বছর একই সময় ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি।
রাজধানীর মালিবাগের নুসরাত ট্রেডিংয়ের মালিক শাহজাহান মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, করোনায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, তাই দেশের বাজারেও বেড়েছে- এমনটাই পাইকারি বাজার থেকে আমাদের বলা হয়। বেশি দামে কিনতে হয়, তাই আমরাও বেশি দামেই বিক্রি করি।
ভোজ্য তেলের দাম সমন্বয় ও বাজার তদারকিতে একটি কমিটি করা হয়েছে বলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘আমাদের তেলের বাজার ৯০ শতাংশই আমদানি নির্ভর। সেখানে বাড়লে আমাদেরও বাড়ে।’ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে তেল বোতলজাত করে বাজারজাতের পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মন্ত্রী বলেন, আমাদের ৭০ থেকে ৭২ শতাংশই খোলা তেল। বোতলজাত করলে সব জায়গায় একই দাম থাকবে।
তেলের মতো আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে দেশের বাজারে বেড়েছে চিনির দামও। চিনি এখন প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। গত বছর এ সময় চিনির দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ।
গরিবের মোটা চালের ভাত, মসুর ডাল আর আলু ভর্তা হলে দিনের খাওয়া হয়ে যায়। এর মধ্যে গত বছরের পুরোটা সময় মসুর ডালের দাম নিম্ন আয়ের মানুষকে ব্যাপক ভুগিয়েছে। ত্রাণের সহায়তার চাপে মোটা মসুর ডালের দাম উঠে গিয়েছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ২৯ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। অবশ্য এখন অনেকটাই কম। তার পরও গত বছরের তুলনায় কেজিতে পাঁচ টাকা বা ৭ শতাংশ বেশি। আর ছোট দানার মসুর ডালের দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশ। গত বছর ছোট দানার মসুর ডালের দাম ছিল কেজিপ্রতি ৯০ থেকে ১৩০ টাকা। এখন ১১০ থেকে ১৪০ টাকা।
গত বছর আটা-ময়দার দাম না বাড়লেও এক মাস ধরে বাড়ছে। টিসিবির হিসাবে, গত মাসের তুলনায় চলতি মাসে প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ। তবে খোলা আটার দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। আর খোলা ময়দার দাম বেড়েছে দেড় শতাংশ। প্যাকেট ময়দার দাম কমেছে ৫ শতাংশ।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com