মোরো সংঘর্ষ: শেষ হইয়াও হইল না শেষ

0

২০১৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘বাংসামোরো অটোনমাস অথরিটি’ গঠনের মাধ্যমে ৫০ বছর ধরে চলমান মোরো সংঘর্ষ শেষ হয়েছে বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হলো। কিন্তু সবাই বলছেন, এই ঘোষণা আসলে অর্থহীন। যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী মোরো সংঘর্ষে জড়িত, তারা কেউই সরকারের এই উদ্যোগে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তাই দুতের্তে সরকারের এই শান্তিপ্রক্রিয়া শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ আছে। ফলে দক্ষিণ ফিলিপাইনের মিন্দানাও শান্তির দেখা পাবে– এমনটা আশা করছে না কেউ।

মিন্দানাও বা দক্ষিণ ফিলিপাইনের পশ্চিম অঞ্চলে মোরো জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। মোরো আসলে একটি সামগ্রিক জাতিগত নাম- ১৭টি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী এর অন্তর্গত। এর মধ্যে আছে সামা, বাজাও, জামা মাপুন, তাউসুগ, সুলুক, ইরানুন, কালাগান, মারানাও, মাগিন্দানাও, পালাওয়ানন, মলবগ, সাঙ্গিল, ইয়াকান, সুবানন, কালিবুগান, বাঙ্গিঙ্গি ও সাঙ্গির। এরা সবাই প্রধানত ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ‘মোরো’ নামটি মুর শব্দের স্পেনীয় রূপান্তর হিসেবে এসেছে। উত্তর আফ্রিকার আরব-বারবাররা ৭৮১ বছর ধরে স্পেন শাসন করার সময় তাদের ‘মুর’ বা ‘মোরো’ বলা হতো। ১৫৬৫ সালে ফিলিপাইনে আসার পর স্পেনীয় উপনিবেশকারীরা দক্ষিণ ফিলিপাইনের মুসলিম জাতিগোষ্ঠীগুলোকে মুসলিম হওয়ার কারণে ‘মোরো’ নাম দেয়।

মোরো জাতি সব সময়েই স্বাধীনচেতা ছিল। ফিলিপাইনে স্পেনীয় শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরদার প্রতিরোধ গড়ে তোলে মোরোরাই। ৩৩৩ বছর ধরে স্পেনের অধীনে থাকা ফিলিপাইনে মোরোরাই শুধু স্পেনীয়দের আধিপত্য অস্বীকার করে চলেছিল। স্পেনীয়দের হাজারো প্রচেষ্টা ও ক্রমাগত সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কখনোই আত্মসমর্পণ করেনি মোরোরা। আঠারো দশকের শেষে এসে স্পেন সরকার মোরো অনেকখানি পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হলেও সম্পূর্নভাবে বশীভূত করতে সক্ষম হয়নি।

এরই মধ্যে স্পেনীয়-মার্কিন যুদ্ধ শুরু হলে ১৮৯৮ সালে স্পেনের আরও অনেক উপনিবেশসহ ফিলিপাইনও মার্কিন দখলে চলে যায়। কিন্তু মার্কিন উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধেও তীব্র বিদ্রোহ করে মোরোরা। প্রথম দিকে মার্কিন সেনাবাহিনী স্থানীয় সুলু সুলতানাতের সাথে সন্ধি করে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল প্রথমে উত্তর ফিলিপাইনকে নিয়ন্ত্রণে আনা, যাতে পরে মোরোদের বশ করা সহজসাধ্য হয়। অবশ্য চুক্তির পরও মোরোদের হাতে মার্কিন সেনা ও অন্যান্য বেসামরিক লোকদের হতাহতের ঘটনা ঘটে। ১৯০৪ সালে মার্কিন সেনারা মিন্দানাওকে দখল করতে সামরিক অভিযান চালায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান মোরোদের মাতৃভূমি মিন্দানাওসহ ফিলিপাইন ও পূর্ব এশিয়ার বিশাল এলাকা দখল করে। এ সময় জাপানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করে মোরোরা। তারা অবশ্য মার্কিন ও ফিলিপিনোদের থেকে কোনো ধরনের সহায়তা গ্রহণ করেনি।

মার্কিন আমল থেকেই মিন্দানাওয়ে উত্তরের লুজন ও ভিসায়াস অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জাতির ফিলিপিনোদের বসত স্থাপন করানো হয়। ফিলিপিনো সরকারের আমলে এই অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ তুঙ্গে ওঠে। বসতকারী অন্য ফিলিপিনোরা প্রায় সবাই মূলত খ্রিস্টান। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মোরোসহ মিন্দানাওয়ের অন্য আদিবাসীরা বাস্তুচ্যুত হয়। মোরো বিদ্রোহের পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ এই ভূমি বিরোধ। খ্রিস্টান ফিলিপিনোরা সাধারণত মিন্দানাওয়ের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে বসতি স্থাপন করে। মার্কিন ও ফিলিপিনো সরকার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে খ্রিস্টানদের প্রাধান্য দেয়। ফলে মোরোদের ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। এর পাশাপাশি মিন্দানাওয়ের খনিজ সম্পদ ঢালাওভাবে আহরণ করা শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার। বিপুল পরিমানে বহিরাগতদের বসতি স্থাপনের জন্য ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি ও বন উজাড় করে ঘরবাড়ি নির্মান করা হয়। এসব কর্মকান্ড স্থানীয় পরিবেশের প্রচুর ক্ষতিসাধন করে। মোরোদের দারিদ্র্যের কোনো সুরাহা অবশ্য হয়নি।

স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের আমলে ১৯৬৮ সালে উত্তর-পূর্ব বোর্নিওতে গোপন সেনা অভিযানের জন্য ‘জাবিদাহ’ নামে কমান্ডো ইউনিট গঠিত হয়।এই ইউনিটের প্রশিক্ষণের সময় কোরেগিদোর দ্বীপে এক ফিলিপিনো সেনা ছাউনিতে ১১ জন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মোরো সেনাকে হত্যা করা হয়। জাবিদাহ হত্যাযজ্ঞ নামক এ ঘটনায় ফিলিপাইনজুড়ে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পরের বছরই সৃষ্টি হয় ‘‘মোরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’’ (এমএনএলএফ)। এদের দাবি ছিল মোরোদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের অধিকার। এমএনএলএফ সশ্সত্র সংগ্রাম শুরু করলে ফিলিপিনো সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। ১৯৭৪ সালে সেনাবাহিনী সুলু দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী জোলো সম্পূর্ণ রূপে পুড়িয়ে দেয়। একই বছর মালিসবং হত্যাযজ্ঞ হয়।

এ সময় পালিম্বাং পৌরসভার মালিসবং গ্রামে এক মসজিদে ১০০০ মোরো মুসুল্লিকে সেনাবাহিনী হত্যা করে। মুসলিম বিশ্বে এ ঘটনা ব্যপক আলোড়ন তোলে। ১৯৭৬ সালে এমএনএলএফ সরকারের সাথে ত্রিপোলি শান্তিচুক্তি করে। ফলে দু’পক্ষের মধ্যে অস্ত্রবিরতি হয়। চুক্তিতে বলা হয়, মিন্দানাও ফিলিপাইনের ভেতর থাকলেও এর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১৩টি রাজ্য নিয়ে স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল গঠন করা হবে। কিন্তু মার্কোস সরকার পরে চুক্তি বাস্তবায়নের পথ থেকে সরে আসে। ফলে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়। সহিংসতা দমনে সরকার খ্রিস্টান বসতকারীদের নিয়ে বেসামরিক সশস্ত্রগোষ্ঠী ‘ইলাগা’ গঠন করে। ইলাগার বিরুদ্ধেও ব্যপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে। ১৯৭১ সালে কারমেন পৌরসভার মানিলি গ্রামে এক মসজিদে নারী-শিশুসহ ৬৫ জন মোরোকে ইলাগার হাতে নিহত হয়।

মার্কোসের পতনের পর গণতান্ত্রিক আকিনো সরকারের নেতৃত্বে ১৯৮৯ সালে সাংবিধানিকভাবে ‘অটোনমাস রিজিয়ন অব মুসলিম মিন্দানাও’ (এআরএমএম) গঠিত হয়। এআরএমএম কার্যত স্বাধীনভাবে প্রশাসনিক কাজ চালাতে থাকে। তবে ১৯৯১ সালে আল-কায়েদা অনুপ্রাণিত ‘আবু সায়াফ’ গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়। এর লক্ষ্য মিন্দানাওয়ে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

কিন্তু জোসেফ এস্ত্রাদার সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০০ সালে ফিলিপিনো সরকার মিন্দানাওয়ে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় ব্যাপক বেসামরিক লোকের প্রাণহানি হয়। অবশ্য ভীষণ সংঘাত-সংঘর্ষের পর সেনাবাহিনী মিন্দানাও পুরোপুরি দখলে নেয়। কিন্তু মোরো যোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ অব্যহত রাখে। অন্যদিকে ইসলামবাদীরা প্রতিশোধ হিসেবে ফিলিপাইন জুড়ে একাধিক সন্ত্রাসী বোমা হামলা চালায়। এরই মধ্যে অবশ্য শান্তি আলোচনাও চলে, তবে তা ফলপ্রসু হয়নি। পরে মাকাপাগাল ও ৩য় আকিনোর সরকারের আমলে মিন্দানাওকে সন্ত্রাসমুক্ত করার অনেক প্রচেষ্টা চালায় কেন্দ্রীয় সরকার।

উগ্রবাদীদের সাথে প্রতিনিয়ত খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত থাকে সেনাবাহিনী। অন্যদিকে মাঝে মাঝেই ফিলিপাইনের বড় বড় শহরগুলোয় সন্ত্রাসী হামলা চালায় প্রধানত ইসলামবাদীরা। এমএনএলএফসহ জাতীয়তাবাদী মোরো সংগঠনগুলোর সাথে আবু সায়াফসহ ইসলামপন্থী মোরো উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো বিরোধও বাড়ে, যা মাঝে মাঝে সংঘর্ষেও রূপ নেয়। মিন্দানাওজুড়ে এমন অশান্তি বজায় থাকে প্রায় দুই দশক ধরে। ইতিমধ্যে আবু সায়াফসহ একাধিক সংগঠন আইসিসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। দুতের্তে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬ সালে দক্ষিণ লানাও প্রদেশের মারাউই শহরে আইসিস-সমর্থক অস্ত্রধারীরা হামলা চালায় ও শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পরে ভীষণ যুদ্ধের পর সেনাবাহিনী মারাউই পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নেয়।

ফলে শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ২০১৯ সালে নতুন স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল ‘বাংসামোরো অটোনমাস রিজিয়ন অব মুসলিম মিন্দানাও’ (বিএআরএমএম) গঠন করে দুতের্তে সরকার মিন্দানাওয়ের মোরোদের রাজনৈতিক অধিকারের দাবি মেনে নেয়। ফলে সরকার দাবি করা শুরু করে, মোরো সংঘর্ষের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী মোরো সংগঠন শান্তিচুক্তিতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও ইসলামবাদীরা তা অগ্রাহ্য করে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ইতিমধ্যে একাধিক সন্ত্রাসী হামলাও চালিয়েছে তারা। ফলে মোরো সংঘর্ষ শেষ হয়েছে, ফিলিপাইনের এমন দাবি কতটুকু বাস্তবসম্মত বা কার্যকর হবে, তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন সবার মনে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com