সিইসি কেএম নূরুল হুদা দেশের গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের বর্তমান দায়িত্বরতদের অসদাচরণ-দুর্নীতি তদন্তে দেশের ৪২ সিনিয়র নাগরিকের প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেছেন। ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে প্রেরণ করা এই চিঠি দেয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে। বিশিষ্টজনেররা প্রধানমন্ত্রীকেও একই দাবি জানিয়ে চিঠি দেবেন বলে জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ইসি’র দায়িত্বরতরা গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ভোটাধিকারহরণ করে ‘নির্বাচনকে নিছক খেলায়’ পরিণত করেছেন। বরেণ্য নাগরিকদের প্রেসিডেন্টকে দেয়া ‘চিঠি’ নিয়ে সর্বেত্রই আলোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারে এ নিয়ে চলছে বিস্তর বিতর্ক।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসির দায়িত্ব নেয়ার পর সিইসি কেএম নূরুল হুদা দেশের গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন বলে তাদের অভিযোগ। সংবিধান পদে থেকে তিনি ব্যাপক দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে দাবি করা হয়। তবে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ও এই খবর নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে কেউ কেউ ‘দেরিতে উদ্যোগ নেয়ায়’ বিশিষ্টজনদের সমালোচনা করেছেন। তাদের বক্তব্য একাদশ নির্বাচনের পর পরই এই উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। কেউ কেউ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে নির্বাচনে জনগণকের ভোটকেন্দ্র বিমুখ করার জন্য দায়িত্বশীলদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
বিশিষ্টজনেররা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) এর বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ সংশ্লিষ্ট অসদাচরণের অভিযোগ তদন্তে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল (এসজেসি) গঠনের আবেদন জানান। এতে বলা হয়, সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান রয়েছে। আবেদনকারীরা জানান, ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। তবে ১১৮(৫) অনুচ্ছেদে ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হইতে পারেন, সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোন নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হইবেন না।’
এদিকে কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ ওঠায় তাদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগের পরামর্শ দিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ(টিআইবি)।
আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিকের প্রেসিডেন্ট বরাবর যে আবেদন করেছেন তা খুবই প্রাসঙ্গিক। বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরাসরি আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অসদাচরণে জড়িয়ে পড়েছে; যা আগে কখনো কোনো কমিশন করেনি। আগের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করে এই সিইসি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করেছেন। জনগনের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।
সিইসি কে এম নুরুল হুদা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নেয়ার পর একাদশ জাতীয় নির্বাচনসহ যত উপনির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচন হয়েছে কোনোটিতেই মানুষ ভোট দিতে পারেনি। তিনি সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর ঘটিয়েছেন। দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন সংক্রান্ত গুরুতর অসদাচরণ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তারা ১৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টকে চিঠি দিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ তুলে ধরেছেন। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন তারা। এ বিষয়ে সরাসরি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার জন্য সময় চেয়ে অনুরোধ করেছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। একই ধরনের চিঠি তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দেবেন বলে জানিয়েছেন।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দেশবাসীকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন দিলীপ সরকার। এতে নির্বাচন কমিশনের ‘গুরুতর অসদাচরণ ও আর্থিক দুর্নীতির’ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরা হয়। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশনারদের বিশেষ বক্তা হিসেবে দুই কোটি টাকা গ্রহণ, নিয়োগের নামে চার কোটি আট লাখ টাকার দুর্নীতি, নিয়মবহির্ভূতভাবে সিইসি ও অন্যান্য কমিশনারদের তিনটি করে গাড়ি ব্যবহার এবং ইভিএম কেনায় অনিয়ম। আর অসদাচরণের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ, ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ।
সংবাদ সম্মেলনে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিকদের অন্যতম ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, আমরা সবাই মনে করেছি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নির্বাচন কমিশন যেসব কার্যকলাপ করেছে সেগুলো গুরুতর অসদাচরণ। সাংবিধানিক পদে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের। দুদক বা পুলিশ এটা করতে পারবে না। প্রেসিডেন্ট এ নির্দেশ দিতে পারেন। সংবিধানের ৪৮ (৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদের আলোচনার জন্য উপস্থাপন করতে পারেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্টকে অভিযোগ জানিয়েছি। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ইসির অসদাচরণের তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা আশা করছি, গুরুতর অসদাচরণের দায়ে তারা দোষী হবেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট তাদের পদ থেকে অপসারণ করবেন। ইসি সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন দেশে কোনও নির্বাচন হয় না। ‘নির্বাচন নির্বাচন খেলা’ হয়। ভোটের নামে নাটক হয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে আমরা খারাপ নির্বাচন বলি। এখন নির্বাচনগুলো সে রকমই হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে দেশ গভীর সংকটে। প্রত্যাশ করছি জাতির স্বার্থে প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচন কমিশনের নাম অবমাননা ও কলঙ্কিত করেছে। প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেছি। একইসঙ্গে সরকার প্রধানের কাছে যাবো, প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আবেদন করবো। যতদিন সিদ্ধান্ত না হয় ততদিন সিইসি ও কমিশনারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারেন, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন আমরা আশা করবো।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিজয়ের মাসে নির্বাচন কমিশন মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এদের অসদচারণ ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বস করার অধিকার তাদের নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আগের অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনগুলোর বৈধতার বিষয় অনেক বড় বিষয়। কারণ, যে দিনের নির্বাচন সে দিনেই হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা দেখেছি ভোট আগের রাতে হয়েছে। বিবিসিসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব তথ্য দেখেছি। তাই গত নির্বাচনগুলোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল বলেন, প্রেসিডেন্ট আমাদের দেয়া চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু পাঠাবেন কিনা সন্দেহ আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আলাদা করে পাঠানো যেতে পারে।
ইসির বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ: বিশিষ্ট নাগরিকরা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পাঠানো অভিযোগ পত্রে সুনিদৃষ্ট অনেকগুলো অভিযোগ তুলে ধরেছেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে –
১. ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার নামে দুই কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম।
২. নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চার কোটি আট লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৩. নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৪. ইভিএম ক্রয় ও ব্যবহারে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৫. একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৬. ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৭. খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৮. গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
৯. সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।
যারা চিঠি দেন: চিঠিতে সই করেছেন এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক মহা হিসাব-নিরীক্ষক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধুরী, মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড. আই খান পান্না, শাহদীন মালিক, আলোকচিত্র শিল্পী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সি. আর. আবরার, আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন এর অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তুজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্লিনিকাল নিউরোসায়েন্স সেন্টার ও বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকার কর্মী ন‚র খান লিটন।