বাবরি মসজিদ-রামমন্দির মামলার রায়ের পর ভারতে তাজমহল বা কাশী-মথুরার মসজিদ কি অক্ষত থাকবে?

0

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার ভেঙে-ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির তৈরির পক্ষে গত শনিবার রায় ঘোষণার পর থেকেই কাশী-মথুরা-আগ্রাতে নতুন আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে।

কারণ ওই রায় সামনে আসার পর থেকেই প্রশ্ন উঠছে, ভারতের আরও নানা জায়গায় যে সব ‘বিতর্কিত ধর্মীয় স্থান’ রয়েছে সেগুলোর ওপর এই রায়ের কী প্রভাব পড়বে?

কাশী ও মথুরার মতো তীর্থস্থানে মসজিদ সরিয়ে ফেলে পার্শ্ববর্তী মন্দিরকে যাতে পুরো জায়গাটা দিয়ে দেওয়া হয়, সেই লক্ষ্যে ভারতের উগ্র হিন্দু সংগঠনগুলোর আন্দোলন অনেক পুরনো।

এমন কী বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহলও তৈরি হয়েছে প্রাচীন এক শিবমন্দিরের ওপর – এমনকি এ রকম একটি দাবিও আজকাল জোরেশোরে উঠছে।

এই পটভূমিতে কাশী-মথুরা-আগ্রাতে মুসলিম প্রার্থনার স্থান বা ইসলামী স্মারকগুলোও কি আজ হুমকির মুখে?

বারাণসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদ ও কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের মাঝখানের দেওয়াল
Image captionবারাণসীতে জ্ঞানবাপী মসজিদ ও কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের মাঝখানের দেওয়াল

আসলে ভারতে এমন বহু তীর্থস্থান আছে, যেখানে মন্দির আর মসজিদ শত শত বছর ধরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে – কখনও বা তারা একই দেয়াল পর্যন্ত শেয়ার করে।

উত্তর প্রদেশে কাশী বা মথুরা, কিংবা মধ্যপ্রদেশে ভোজশালার মতো এমন বহু শহরের জন্যই কিন্তু অযোধ্যার রায় এক ধরনের অশনি সংকেত – যা সেই সহাবস্থানের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে।

এমনকি ১৯৯১ সালে এ দেশে পাস হওয়া ‘ধর্মীয় উপাসনালয় আইন’ও সেখানে পুরোপুরি ভরসা জোগাতে পারছে না।

ভারতের নামী ইতিহাসবিদ মৃদুলা মুখার্জি ওই আইনটির প্রসঙ্গ তুলে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ওই আইনে শুধু ছাড় দেওয়া হয়েছিল রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্ককে, কারণ সেটা নিয়ে তখন আন্দোলন তুঙ্গে।”

“কিন্তু সেই সঙ্গেই পরিষ্কার বলা হয়েছিল, অযোধ্যা ছাড়া ভারতের অন্য সব ধর্মীয় স্থানে যেভাবে এখন উপাসনা চলছে সেভাবেই চলবে – সেটা কিছুতেই বদলানো যাবে না।

“কিন্তু আমরা এটাও জানি রাজনীতি অন্য জিনিষ, রাজনীতির কারবারিরা সব সময় আইনকানুনের ধার ধারেন না।”

“ফলে বিজেপি, আরএসএস বা তাদের সমমনা অন্যান্য কট্টর সংগঠনগুলো এই অযোধ্যা রায়কে যে কীভাবে কাজে লাগায়, সে আশঙ্কা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে”, বলছিলেন দিল্লিতে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ এই অধ্যাপক।

অযোধ্যায় ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছিল এই বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরাই, আর এখন সেখানেই নির্মিত হতে যাচ্ছে রাজসিক রামমন্দির।

গঙ্গাবক্ষ থেকে বারাণসীর বিখ্যাত কাশী-বিশ্বনাথ মন্দির
Image captionগঙ্গাবক্ষ থেকে বারাণসীর বিখ্যাত কাশী-বিশ্বনাথ মন্দির

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সংসদীয় কেন্দ্র বারাণসী বা কাশী – সেখানে জ্ঞানবাপী মসজিদের দেয়াল ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির।

মথুরাতেও শাহী ঈদগাহ মসজিদ আর শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দির কমপ্লেক্স ঠিক পাশাপাশি, প্রাচীন মন্দির ভেঙে এখানেও মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মসজিদ গড়েছিলেন বলে দাবি করা হয়।

এমনকি আগ্রার বিশ্ববিখ্যাত তাজমহলও নাকি আসলে আগে শিবমন্দির ছিল বলে অনেকে বলছেন, আর তাতে প্রচ্ছন্ন সায় দিচ্ছে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারও।

যদিও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রেসিডেন্ট আলোক কুমারের বক্তব্য, তাদের যাবতীয় ধ্যানজ্ঞান এখন থাকবে শুধু রামমন্দির নির্মাণেই – অন্য কোনও দিকে মন দেয়ার সময়ই হবে না।

তিনি বিবিসিকে বলেন, “এই রায় রাম জন্মভূমিতে যে মন্দির বানানোর রাস্তা খুলে দিল, সেটা শেষ করতে আমাদের তো এখন কয়েকটা বছর লাগবেই।”

“আমরা পুরো মনোযোগ ওতেই দেব … ফলে আপনি যে কাশী-মথুরার কথা বলছেন সেদিকে আমরা এখন মন দিচ্ছি না, কোনও দাবিও জানাচ্ছি না।”

অথচ বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এই হিন্দুত্ববাদীদেরই স্লোগান ছিল ‘ইয়ে তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায় – কাশী মথুরা বাকি হ্যায়’।

অর্থাৎ কিনা, “বাবরিতে তো শুধু একটা ধাক্কা দিয়েছি, এরপর ধরব কাশী-মথুরাকে – ওগুলো মেটানো বাকি আছে।”

মথুরায় ঠিক পাশাপাশি অবস্থিত শাহী ঈদগাহ মসজিদ ও শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দির
Image captionমথুরায় ঠিক পাশাপাশি অবস্থিত শাহী ঈদগাহ মসজিদ ও শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দির

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং বা তার মতো আরও অনেকেই এখনও নিয়ম করে এ ধরনের হুমকি দিয়ে থাকেন।

তবে এই তথাকথিত ‘অসমাপ্ত এজেন্ডা’ নিয়ে এখন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাচ্ছে আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘও।

আরএসএস-এর প্রধান মোহন ভাগবত যেমন রায় ঘোষণার দিনই বলেছেন, “দেখুন সঙ্ঘ তো ওই ধরনের আন্দোলন করে না, আমরা মানুষ গড়ার কাজ করি।”

“ঐতিহাসিক কারণে আমরা রাম জন্মভূমি আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু এছাড়া আর অন্য কোনও ইস্যুর সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।”

কিন্তু সঙ্ঘ পরিবারের এই মুখের কথাকে বিশ্বাস করা যায়, ইতিহাস কিন্তু তা বলে না।

ড: মৃদুলা মুখার্জি মনে করছেন আন্তর্জাতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় তাজমহলে হয়তো তারা এখনই হাত দেবে না।

তবে এলাহাবাদ বা মুঘলসরাইয়ের নাম বদলের মতো ছোট ছোট পদক্ষেপে তাদের ‘দৈনন্দিন সাম্প্রদায়িকতা’ কিন্তু থেমে নেই।

“এই যে দুম করে এলাহাবাদ শহরের নাম বদলে দিল, কিংবা মুঘলসরাই স্টেশনের নাম রাখল বিজেপি-জনসঙ্ঘের তাত্ত্বিক নেতার নামে – এই ধরনের পদক্ষেপ কিন্তু তারা নিতেই থাকবে।”

মুঘলসরাই স্টেশনের নাম পরিবর্তনের অনুষ্ঠানে বিজেপির শীর্ষ নেতারা
Image captionমুঘলসরাই স্টেশনের নাম পরিবর্তনের অনুষ্ঠানে বিজেপির শীর্ষ নেতারা

“মানে ছোট ছোট শহরে, ছোট ছোট নেতা বা ধরা যাক স্থানীয় এমপি-রা এই রকম ছোটখাটো নানা ইস্যুতে কনফ্লিক্ট বা সংঘাত তৈরি করতেই থাকবেন” – বলছিলেন ড: মৃদুলা মুখার্জি।

“যেটাকে আমরা বলতে পারি ‘এভরিডে কমিউনালিজম’ বা রোজকার সাম্প্রদায়িকতা!

“আসলে এই যে ‘হিন্দুত্ব প্রোজেক্ট’ বা হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, সেটা তো সঙ্ঘের ঘোষিত এজেন্ডার মধ্যেই পড়ে। তারা তো খোলাখুলিই বলে যে তারা হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করতে চায়।”

“আর সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের মধ্যে যে গভীর একটা অ্যান্টি-মুসলিম বায়াস বা প্রবল মুসলিম-বিদ্বেষ আছে সেটা তো অস্বীকার করা যায় না”, বলছিলেন অধ্যাপক মুখার্জি।

ফলে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের সেই মূল লক্ষ্যর বাস্তবায়ন পর্যায়ক্রমে চলছেই।

আর সে কারণেই কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরার শাহী ঈদগাহ মসজিদ বর্তমান আকারেই চিরকাল অক্ষত থাকবে, তা খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

এমন কী পৃথিবীর সেরা স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য তাজমহলও তার পরিচয় নিয়ে পুরোপুরি নিরাপদ থাকতে পারছে না।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com