যুক্তরাষ্ট্রকে যে বিপদের দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ট্রাম্প

0

১৭৮৯ সালের ৩০ এপ্রিল জর্জ ওয়াশিংটন প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রচিত শাসনতন্ত্রকে রক্ষা, সংরক্ষণ এবং প্রতিরক্ষা করার শপথ গ্রহণ করেছিলেন। সে সময়ে আমেরিকার ফেডারেল সরকারের কর্মচারীদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন কেরানি এবং সর্বসাকুল্যে ৬৭২ জনের মতো আর্মি অফিসার ও সৈন্য ছাড়া আর কিছুই ছিল না, তাও তাদের অনেক মাসের বেতন ছিল বকেয়া । তখনো জনসাধারণের ওপর কোনো ট্যাক্স ও নির্ধারিত ছিল না। জর্জ ওয়াশিংটনের ধনী হিসেবে খ্যাতি থাকলেও সেই সময় তাকে ৩০০০ ডলার ঋণ নিতে হয়েছিল। উপরোল্লিখিত অবস্থা থেকে পরবর্তীকালেও বিপুলসংখ্যক মহান ব্যক্তিত্বের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ হওয়ায় আজকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বে অপরাজেয় অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।

যখন ট্রাম্প আমেরিকার ‘অদ্বিতীয় মেধাসম্পন্ন’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, বিশ্বের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের মানসিক যন্ত্রণার সীমা থাকে না। এটি আমেরিকার মহান স্থপতিদের জন্য কত বড় অবমাননা তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।

আসলে ট্রাম্পের চার বছর ক্ষমতায় থাকার সময়ে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে নেতিবাচক সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন (যেমন: ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বন্ধ করা সংক্রান্ত চুক্তি থেকে দেশকে প্রত্যাহার, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করা ইত্যাদি) উক্ত সিদ্ধান্তগুলোর সাথে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দ্বিমত পোষণ করলেও সে ব্যাপারে তাদের কোনো তীব্র প্রতিবাদ লক্ষ করা যায়নি। অথচ গত চার বছরে ট্রাম্প প্রশাসন তারই নির্দেশে অনেক ক্ষেত্রে সংবিধানবিরোধী কাজকর্ম চালিয়েছেন এবং অনেক বড় বড় দুর্নীতির সাথে তার পরিচালিত সরকারের অনেকেই জড়িত তারই জ্ঞাতসারে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন ‘Lock her up’। বর্তমানে ট্রাম্পকে বন্দী না করা হলেও তার শাসনকালে আমেরিকার অতি যত্নে এবং দীর্ঘ সময় ধরে লালিত রাষ্ট্র সংক্রান্ত মূল্যবোধগুলো কিভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, তার বিবরণ দেয়ার জন্য একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করা অতীব প্রয়োজন। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতিদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফলে যেসব শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আমেরিকায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বিশ্বের সমস্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ওইসব মূল্যবোধ দিয়ে উপকৃত হয়েছে, সে মূল্যবোধগুলো সারাবিশ্বে স্থায়িত্ব লাভ করবে।

বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশেই বছরের পর বছর অনেকটা বলপ্রয়োগের দ্বারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সীমাহীন স্বৈরশাসন চালানোর পরও, সংগ্রামের ফলে ওইসব স্বৈরাচারী শাসক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পর্যবেক্ষণ শেষে দেখা গেছে, ক্ষমতাচ্যুতির পর ওই স্বৈরাচারীদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ ক্ষমতাকালীন লুট করা সম্পদ নিয়ে বর্ণাঢ্য জীবনযাপন করছেন। ইতোমধ্যেই তাদের অনেকেই যথেষ্ট ‘পূজারী’ও সৃষ্টি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। গোপনে অঢেল বেআইনি সম্পদ থাকায় যেকোনো সময়ে তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে তারা আবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করা বিচিত্র নয়।

সম্প্রতি প্রিন্সটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়ার্নার মুলার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, তিনটি বিষয়ে ট্রাম্পের ব্যাপারে তদন্ত হওয়া উচিত। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে তার দুর্নীতি, ক্ষমতায় থাকাকালীন তার এবং তার অন্তরঙ্গদের দুর্নীতির বিবরণ এবং ক্ষমতাকালীন তার অগণতান্ত্রিক আচরণ যা আমেরিকার শাসনতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক ত্রুটি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এসবের বিশদ তদন্ত শেষে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য জরুরি। ম্যানহাটনের জেলা অ্যাটর্নি জেনারেল ইতোমধ্যেই ট্রাম্পের বিভিন্ন বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির এবং অন্যান্য প্রতারণার তদন্ত শুরু করেছে। এরই মধ্যে তার বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মারাত্মক অনিয়ম এবং নিয়মবহির্ভূত ও অনৈতিক কাজকর্ম উদঘাটিত হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য হাঙ্গেরির স্বৈরাচারীদের মতো দেশকে মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করতে না পারলেও গণতান্ত্রিক বিশ্বের শিরোমণি ও নেতৃত্বদানকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কোনো সোচ্চার ভূমিকা না থাকায় গণতান্ত্রিক বিশ্ব হতাশ ও নিরুৎসাহিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সাবেক প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকালীন অনেক ভুলভ্রান্তি সহ্য করা হয়েছিল; কারণ সে কার্যাবলি যুক্তরাষ্ট্রের মূল শাসনতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোকে আঘাত করেনি। কিন্তু ট্রাম্পের দুর্নীতি, কোভিড-১৯ নিয়ে তার কাণ্ডকীর্তি এবং আমেরিকার সীমান্তে উদ্বাস্তু থেকে হাজার হাজার অবুঝ শিশু কেড়ে নেয়ার যে জঘন্য অমানবিক, মানবতাহীন ও অবিশ্বাস্য অপকর্ম, তা মানবজাতি কোনো দিন ভুলতে পারে না। সে জন্য ইদানীং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শাস্ত্রের অধ্যাপক মার্ক টুসনেট ট্রাম্পের সব অমানবিক কাজের একটি বিশদ তদন্তের জন্য একটি উচ্চাঙ্গের কমিশন গঠন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

আমেরিকায় নিক্সন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ‘ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি’র তদন্তের জন্য এবং প্রেসিডেন্টের নৈতিক স্খলন প্রতিরোধ করার জন্য অনেক আইন তদানীন্তন কংগ্রেস অনুমোদন দিয়েছিল। ট্রাম্পের ব্যাপারে সেসব আইনও প্রয়োগ করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা যায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আইনজ্ঞ একটি আলাদা কমিশন গঠন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদ সংক্রান্ত ভুলভ্রান্তিগুলো নিরসনের একটি পন্থা বের করার পরামর্শ দিয়েছেন। যা হোক, ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো দিন পেশাদার সক্রিয় রাজনীতিবিদ ছিলেন না। কাজেই আমেরিকানদের আত্মিক বৈশিষ্ট্য বুঝে নেয়া তার পক্ষে সম্ভব না হওয়া বিচিত্র নয়। বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রনায়করা যুগে যুগে বলেছেন- একটি জাতির রাষ্ট্রনায়ক সাধারণ মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়, যেখান থেকে তাদের আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। আজ যুক্তরাষ্ট্রও সে দুঃসহ অবস্থায় পতিত হয়েছে বলে মনে হয়। নির্বাচনের ঘোষিত ফলাফলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রচুর ভোট পেয়েছেন। এতে বোঝা যায় ট্রাম্পের স্লোগান ‘America First’ আমেরিকার জনগণের একটি বিরাট অংশই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু হিটলার জার্মানিকে ফার্স্ট করার মানসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু করে বিশ্বের কী বারোটা-ই না বাজিয়েছেন, তা ওই আমেরিকানদের মাথায় আসেনি।

আমেরিকার সাধারণ ভোটারদের ভোট সর্বমোট ট্রাম্প পেয়েছেন ৭১ মিলিয়ন আর জো বাইডেন পেয়েছেন ৭৪ মিলিয়ন। তার অর্থ দাঁড়ায়, আমেরিকার ভোটারদের ৪৮ শতাংশ সমর্থন ট্রাম্প পেয়েছেন। সব থেকে উদ্বেগের বিষয় হলো, তার সমর্থকদের মধ্যে উগ্রপন্থীরা বেশি, যারা আহ্বান পেলেই অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের উগ্রপন্থীদের স্লোগান হলো ‘America First’ তারা ট্রাম্পের জন্য জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ওয়াশিংটন, লিংকন, রুজভেল্ট, আইসেনহাওয়ার, কেনেডির মতো মহান ব্যক্তিত্ব, সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন- Nobody did as much for America as I did; nobody created as much jobs in the U.S.A as I did, nobody did (this or that) as much as I did.

এভাবে গত চার বছর অনর্গল মিথ্যাচার করার পরও যদি ট্রাম্প ৪৮ শতাংশ ভোট পান তাহলে বুঝতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮ শতাংশ ভোটার বিশ্বে আরেক হিটলার সৃষ্টি করতে প্রস্তুত রয়েছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক জনসাধারণের অতীব সজাগ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com