নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলেছে: সুজন
আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলেছে বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিবেকশূন্য হয়েছেন। তারা ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করছেন। সরকারি কর্মচারীদের সিংহভাগ সরকারদলীয় কর্মীর মতো আচরণ করছেন। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন এখন কল্পনায় পরিণত হয়েছে। ভোটাধিকার হারিয়ে মানুষ এখন রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছে সুশীল সমাজ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ মতামত দেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার তার লিখিত প্রবন্ধে বলেন, গণতন্ত্র হল জনগণের সম্মতির শাসন, যে সম্মতি প্রতিষ্ঠা হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের প্রতিনিধিত্ব করার লক্ষ্যে বেছে নেয়। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষমতা জনগণের স্বার্থে ও কল্যাণে ব্যবহার করে। তবে বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ ভিন্ন, কারণ ক্ষমতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর অপব্যবহার ও কুক্ষিগতকরণ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় কতগুলো প্রতিষ্ঠান- সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ ও রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’ বা নজরদারিত্বের কাঠামো গড়ে তোলা হয়। এ নজরদারিত্বের কাঠামো কার্যকারিতা প্রদর্শন করলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কার্যকর হয়।
বদিউল আলম আরও বলেন, আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে কয়েকটি সুস্পষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে। দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতাও আমাদের উচ্চ আদালত কমিশনকে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন বহু অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আমাদের নির্বাচন কমিশন ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার- অনেকগুলো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তারা তদন্ত করেছে বলেও আমরা শুনিনি। এটি অনস্বীকার্য যে, সরকার ও রাজনৈতিক দল, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল না চাইলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব। এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও। তবে এক্ষেত্রে কমিশনের হতে একটি বড় অস্ত্র রয়েছে, যা হল নির্বাচন বন্ধ করে দেয়া। অনেকের ধারণা যে, একতরফা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে কাজী রকিবউদ্দিন কমিশন সাহসী ভূমিকা নিলে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসই হয়তো ভিন্ন হতো।
বদিউল আলম বলেন, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নূরুল হুদা কমিশনের সব ক্ষমতা থাকলেও সে ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এটি সুস্পষ্ট যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অসততা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আমাদের অসংখ্য নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ করেছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে তারা ভোট দিতে চাইলেও ভোট দিতে পারবে না। আর ভোট দিলেও তারা ‘ফলাফল’ প্রভাবিত করতে পারবে না- যারা জয়ী হওয়ার তারাই জয়ী হবেন। কেন্দ্রভিত্তিক নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণ থেকে আমরা দেখেছি, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফল বহুলাংশে বানোয়াট। তাই এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাই আজ ভেঙে পড়েছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে ফেলেছে। এছাড়াও আমাদের রাজনীতি আজ বহুলাংশে বিরোধী দলশূন্য হয়ে পড়েছে, যার দায় অবশ্য আমাদের প্রধান বিরোধী দলও এড়াতে পারে না। ফলে বহু নাগরিকের মধ্যে আজ চরম অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।