যেভাবে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে ভারতের গণতন্ত্র

0

ভারতের সংবিধানের একটি প্রস্তাবনা আছে। খুব বেশি লোক এই প্রস্তাবনা পড়েনি বা এর তাৎপর্য বুঝতে পারেনি। এমনকি যারা মৌলিক অধিকার, অনুচ্ছেদ ৩২ বা জরুরির মতো ধারাগুলোর সাথে পরিচিত, তাদের অনেকেও প্রস্তাবনায় থাকা এসব শব্দের সাথে পরিচিত নয়।

সাংবিধানিক পরিষদের এটি গ্রহণের দিনে বলা হয়েছিল, প্রস্তাবনা ঘোষণা করছে যে আমরা, ভারতের জনগণ ভাবগম্ভীরভাবে ভারতকে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি।(সমাজতান্ত্রিক ও সেক্যুলার শব্দগুলো ১৯৭৭ সালে যোগ করা হয়েছিল।)প্রস্তাবনায় এই সিদ্ধান্তও জানানো হয় যে আমরা ভারতের সব নাগরিকদের জন্য এগুলোও নিশ্চিত করছি :

• ন্যায়বিচার
• স্বাধীনতা
• সাম্যতা
এবং সবর মধ্যে বিকশিত করা
• ভ্রাতৃত্ববোধ…

এসব বাক্যে দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে আমরা জাতি হিসেবে কেমন এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্র কী।
এসব শব্দ চিরকালীন
এসব শব্দ প্রতিধ্বনিত হতো ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯)মূলমন্ত্রে : মুক্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ বা মৃত্যু।
অনেক দেশ তাদের সংবিধানে এই তিনটি শব্দ কোনো না কোনো আকারে গ্রহণ করেছে। ভারতের মতো তারাও নিজেদের উদার গণতান্ত্রিক দেশ দাবি করছে। ক্রমবর্ধমান হারে ভারতসহ অনেক দেশে আসলে এ ধরনের দাবিকে ফাঁকা ঘোষণায় পরিণত করেছে। অনেক দেশ এমনকি গণতন্ত্রের প্রথম পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হতে পারে না, গণতন্ত্রটি উদার কিনা, তা অনেক দূরের ব্যাপার।

অন্ধকারে পতন
টাইম ম্যাগাজিনের সাম্প্রতিক সংখ্যায় বিশ্বের ১০০ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী লোকের খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমি ছয়জন রাষ্ট্র/সরকার প্রধানের নাম গুণেছি : মি. নরেন্দ্র মোদি, মি. শি জিনপিং, মিসেস অ্যাঙ্গেলা মর্কেল, মি. জাইর বোলসোনারো (ব্রাজিল), মি. ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মিজ সাই ইঙ ওয়েন (তাইওয়ান)। এই ছয়জনের কেউই দাবি করতে পারবেন না যে ওই দুজন গণতন্ত্রী। মি. মোদি ও মি. ট্রাম্প আসলে ইলেক্টরাল গণতন্ত্রের নেতা। তবে তা সত্ত্বেও তারা উদার তকমা প্রত্যাখ্যান করবেন। কেবল মর্কেল ও সাই হলেন সত্যিকারের উদার গণতান্ত্রিক নেতা। আপনি যদি বিশাল ও শক্তিশালী দেশগুলোর প্রধানদের এই তালিকায় স্থাপন করেন, তবে ছবিটি আরো খারাপ দেখাবে। মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকা এবং আমাদের নিকট প্রতিবেশীদের মধ্যে আমরা স্বৈরতন্ত্র ও ইলেক্টরাল গণতন্ত্রের সাক্ষাত পাব, কিন্তু সত্যিকারের উদার গণতন্ত্রের সাক্ষাত পাব না।

টাইমকে যা বলতে হয়েছে
মি. মোদি : “… ‘দালাই লামা সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতার উদাহরণ হিসেবে ভারতের প্রশংসা করেছেন।‘ নরেন্দ্র মোদি এগুলোর সবই আরো কম নিশ্চিত করেছেন। তার দল কেবল অভিজাততন্ত্রই নয়, বহুত্ববাদও প্রত্যাখ্যান করেছে।… মহামারির মহাপরীক্ষা ভিন্নমতকে গলা চেপে ধরার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণবন্ত গণতন্ত্র আরো গভীর অন্ধকারে ডুবে গেছে।“
অন্য দেশগুলোও অন্ধকারে পতনের দিকে ছুটছে। বিচারপতি রুথ বাদর জিঙসবার্গের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটু সময়ও নষ্ট না করে বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটকে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করেছেন। তিনি নজিরবিহীন ৩০ দিনের মধ্যে মনোনয়নপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফেলেছেন। উদার আমেরিকা, বিশেষ করে নারীরা এই ভেবে উদ্বিগ্ন যে স্কুল একীভূতকরণ, গর্ভপাতের অধিকার, অ্যাফোরডেবল কেয়ার অ্যাক্ট ও বৈষম্যহীন অভিবাসনের মতো ক্ষেত্রগুলোতে অর্জিত সাফল্যগুলো হয়তো মুছে যাবে।

আমরা কারা?
গণতন্ত্র উদার দেশের সমান নয়। গণতন্ত্র সামান্য সময়ের ব্যবধানেই অ-উদার হয়ে যেতে পারে। ভারতের ক্ষেত্রে তাই ঘটছে। লাখ লাখ লোকের নাগরিকত্ব সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে, কথা বলার স্বাধীনতা হ্রাস করা হয়েছে, মিডিয়া ভীত হয়ে পড়েছে, বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা হয়েছে বা মারাত্মকভাবে সীমিত করা হয়েছে, রাজনৈতিক পক্ষত্যাগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে, একটি ধর্ম বা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে সংস্কৃতি হিসেবে ধরা হচ্ছে, সংখ্যালঘু ও বৈষম্যের শিকার সম্প্রদায়গুলো ভয়ের মধ্যে বাস করছে, পুলিশ আইন নয় বরং তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের আদেশ পালন করছে, সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ইস্যুতে কথা বলছে, কর ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, আদালতগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করা বা ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে, আইনের শাসন ভেঙে পড়ছে। কষ্টকর বিষয় হলো, কী ঘটছে, তা দেখতে পাচ্ছেন খুব কম সংখ্যক লোকই। আর যারা দেখতে পাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই আবার নীরব থাকছেন।

পার্লামেন্টে যখন ভোট ছাড়াই আইন পাস হয়, রাজনৈতিক নেতারা যখন কোনো অভিযোগ ছাড়াই কয়েক মাস ধরে বন্দী থাকেন, লেখক, কবি, অধ্যাপক, ছাত্র ও সামাজিক অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে যখন দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়, প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েক শ’ বছরের পুরনো একটি মসজিদ ভাঙার মামলায় যখন কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা না হয়, যখন একটি মেয়েকে ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে হামলা করার পরও অপরাধীদের গ্রেফতার করা হয় না, যখন এনকাউন্টার শব্দটি পুলিশের অভিধানে ঢুকে পড়ে, যখন অভিভাবক গভর্নরেরা নির্বাচিত সরকারে পথে বাধা হয়ে থাকেন, যখন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে মাথাহীন করে রাখা হয় বা অনেক পদ শূন্য রাখা হয়, তখন দেশ অন্ধকারের আরো গভীরে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়ে দেয়।

২০১৯ সালের নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের একটি মসজিদে এক বন্দুকধারী ৫১ জনকে হত্যা করার পর প্রধানমন্ত্রী জ্যাসিন্দা আর্দেন বলেছিলেন, তারা আমাদের লোক। আমাদের বিরুদ্ধে যে লোক এ সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়েছে, সে আমাদের নয়।
আমরা এ ধরনের কথাই শুনতে চাই। এমনকি আমরা যখন উদার গণতন্ত্রের মন্থর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছি, তখনো আমরা অবশ্যই নিজেদের প্রশ্ন করব, ‘আমরা কারা?

সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com