পরাশক্তি হওয়ার চীনা সক্ষমতা

0

বিশ্ব নিয়ন্ত্রক হওয়ার সক্ষমতার অনেক বৈশিষ্ট্য অর্জন ইতোমধ্যে হয়ে গেছে চীনের। আরো কিছু সক্ষমতা অর্জন পর্যায়ে রয়েছে। কিছু বিষয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। অবশ্য কিছু দিককে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এমনটি লক্ষ করা যাচ্ছে না। ২০২০ সাল নাগাদ চীন হয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যা ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এটি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে পারে। সার্বিক প্রতিরক্ষা সক্ষমতার বিচারে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরেই এখন চীনের স্থান। যদিও অতি উচ্চ প্রযুক্তির সমরাস্ত্র বিবেচনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বেইজিং। আর শিল্প প্রযুক্তি ও উন্নয়নে চীন এখনো বিকাশমান স্তর অতিক্রম করেনি। এ ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইউরোপের মৌলিক প্রযুক্তিনির্ভরতা চীনের রয়ে গেছে। শিল্প ভিত্তি সম্প্রসারণে জীবাষ্ম জ্বালানি ও রেয়ার আর্থ বা মূল্যবান ধাতবের মৌলিক ভূমিকা রয়েছে। জ্বালানি বিষয়ে চীন বহুলাংশে আমদানিনির্ভর। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জীবাষ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কম বেশি থেকে যাবে। চীন এ চাহিদা মেটাতে ইরান ও রাশিয়ার সাথে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করছে। অন্য দিকে ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটার সামগ্রী উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল ‘মূল্যবান ধাতব’ এর ৮০ শতাংশ চীন সরবরাহ করে বিশ্ব বাজারে। এটি চীনা শিল্পায়নের একটি মৌলিক ভিত্তি।

জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি উৎকর্ষতা ও গবেষণায় চীন এখনো বৈশ্বিক মান থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে হয়। মিত্র দেশগুলোকে ছায়াদানের ক্ষেত্রে চীনা নীতি হলো অনেকখানি ‘সরকার টু সরকার’ সম্পর্ক ধরনের। অর্থাৎ সরকারে গেলে গভীর সম্পর্ক। ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লে সব সম্পর্ক আর বজায় রাখা হয় না। ফলে চীনের নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবাদর্শের বলয় এক সময় যে ধরনের ছিল সেটি এখন নেই। এছাড়া পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে অভিবাসনের যে সুযোগ ও প্রক্রিয়া থাকে সেটি চীনের নেই। বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রাপ্তিতে এটিকে চীনের একটি ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

চীনের এই সক্ষমতা ও ঘাটতির মধ্য দিয়েই ২০১৪ সাল থেকে দেশটি পররাষ্ট্র কৌশলে অন্য দেশে হস্তক্ষেপ না করার খোলস থেকে বের হতে শুরু করে। মাও শে তুং উত্তর চীনকে মুক্তবাজার ও বিশ্বায়ন ধারায় নিয়ে গিয়ে দেং জিয়াও পিং অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধি ও শক্তি অর্জনের পথে নিয়ে গেছেন। শি জিন পিংয়ের হাতে নেতৃত্ব আসার পর ‘বেল্ট ও রোড’ প্রকল্পের মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রভাব বলয় সৃষ্টির ব্যাপারে বেশ খানিকটা আগ্রাসী ধরনের নীতি কৌশল নিতে শুরু করেছে চীন। আর এই সময়টাতে আমেরিকার নেতৃত্বে আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতা। আমেরিকান পররাষ্ট্র কৌশলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তার বৈদেশিক নীতির জন্য এক প্রতিপক্ষের প্রয়োজন হয়। একুশ শতকের প্রারম্ভিক সময় থেকে সে প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত ছিল ‘ইসলামিক শক্তি’। হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব ধারণা এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি করেছিল। আমেরিকান নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে আন্তর্জাতিকভাবে সেই নীতির প্রয়োগ করা হয়। এর পাশাপাশি রাশিয়াকেও যুক্তরাষ্ট্র এক পর্যায়ে বৈশ্বিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। কিন্তু এখন তাত্ত্বিকভাবেও আমেরিকান প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করা হচ্ছে চীনকে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকান তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ভাবনার পরিবর্তন আসতে থাকে। রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌশলগত কিছু বোঝাপড়া হয়েছে বলে মনে হয়। যার ফলে গত চার বছর রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সঙ্ঘাত লক্ষ করা যায়নি। বরং মধ্যপ্রাচ্যে রুশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিপূরক ভূমিকা লক্ষ করা গেছে অন্তরালে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার উপস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রকে তার অবস্থান ত্যাগ করতে দেখা যায়। আর এই সময়টাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকে চীন। ট্রাম্প চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করে আমেরিকান বাজারকে চীনা পণ্যের জন্য সঙ্কুচিত করে ফেলেন। চীনে আমেরিকান কোম্পানির বিনিয়োগ অনেকখানি বন্ধ হয়ে যায়। একই সাথে সামরিক সঙ্ঘাতের মেরুকরণ ও জোট গঠন প্রক্রিয়া চলতে থাকে একটি সর্বাত্মক দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতের প্রস্তুতি হিসেবে।

২০২০ সালের শেষ প্রান্তিকে এসে বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের যে দৃশ্যপট এখন দেখা যাচ্ছে তাতে আমেরিকা চীনকে তার এশীয় অঞ্চলে সীমিত করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ লক্ষে আমেরিকা এশিয়ায় তার মিত্র দেশগুলোকে একই জোটে সংগঠিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো প্যাসিফিক জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। এর মধ্যে ভারত অস্ট্রেলিয়া জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে নিরাপদ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর গড়ার নামে ‘কোয়াড’ নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছে। এর আওতায় বেশ কয়েক দফা সামরিক মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে।

এর বিপরীতে চীন অপর বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার সাথে একটি কৌশলগত বোঝাপড়া তৈরি করেছে। যার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে আমেরিকান একাধিপত্য খর্ব করা। ইউক্রেনে রাশিয়ান সামরিক হস্তক্ষেপ ও দখলদারিত্বের প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়ার ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ মস্কোর বেইজিংনির্ভরতা বেশ খানিকটা বাড়িয়েছে। অন্য দিকে প্রভাবশালী বিশ্ব শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা চীনকে রাশিয়ান প্রতিরক্ষা চুক্তি ও সমরাস্ত্রের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগী করেছে। আর দু’দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় রাশিয়া জ্বালানির একটি টেকসই বাজার পেয়েছে অন্যদিকে চীন এক ধরনের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে কৌশলগত সহযোগী লাভ করেছে।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com