কাবুল-তালিবান আলোচনা সত্ত্বেও আফগান শান্তিপ্রক্রিয়া এখনো অনিশ্চিত

0

আফগান সরকার ও তালিবান ‌১২ সেপ্টেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় তাদের সরাসরি আলোচনা শুরু করেছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার পর আফগান সরকার ও তালিবানের মধ্য এটিই প্রথম সরাসরি আলোচনা। 

যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ শুরু করে, সামিরক অভিযানের মাধ্যমে আফগানিস্তান দখল করে। ওই সময় আফগান তালিবানকে বিবেচনা করা হতো আল কায়েদার পৃষ্ঠপোষক। যুক্তরাষ্ট্র ওই সরকারকে উৎখাত করে। তারপর থেকে তালিবানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপকভিত্তিক ও অব্যাহত হামলা চালিয়ে আসছে। 

গত ১৯ বছরের লড়াইয়ে আফগান তালিবান কেবল টিকে থাকেনি, সেইসাথে আরো শক্তিশালীও হয়েছে। তারা এখন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে সমান মর্যাদায় আলোচনা করছে। সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রকে তালিবানের সাথে আলোচনা করতে অনুরোধ করতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো প্রভাব প্রদর্শন করার পরই মার্কিন সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করতে রাজি হয় তালিবান। 

এর আগে আফগান সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করতে তালিবানরা আগ্রহী ছিল না। কারণ তারা বিশ্বাস করত যে আফগান সরকার হলো যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল, তারা আফগান জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার মতো যোগ্য নয়। 

মার্কিন সামরিক হামলার প্রধান টার্গেট হয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় প্রবেশ করে এবং তারপর সমান মর্যাদায় আফগান সরকারের সাথে আলোচনা করে তালিবান কেবল আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে প্রভাব বিস্তারের প্রধান শক্তিতেই পরিণত হয়নি, সেইসাথে তারা তাদের মর্যাদাকেও ধীরে ধীরে বৈধ করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ক্রমবর্ধমান হারে তাদের মূল্যায়ন করছে। 

পাকিস্তানের প্রধান ভূমিকা

আফগানিস্তানের প্রতিবেশী পাকিস্তান কেবল আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক দখলদারিত্ব ও মার্কিন সমারিক অভিযানে সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় শিকারই নয়, সেইসাথে আফগানিস্তানের শান্তি ও সমন্বয় প্রক্রিয়ার কঠিন পরিস্থিতিও সামাল দিয়েছে। 

একুশ শতকের শুরুতে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য করেছিল আফগান তালিবানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক হামলাকে সমর্থন করতে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তান বিপুল আত্মত্যাগ করেছে। ২০০১ সাল থেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ৭০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি নিহত হয়েছে, অর্থনৈতিক ক্ষতি ২৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। 

আফগান যুদ্ধক্ষেত্রে মার্কিন সৈন্যরা ধীরে ধীরে ‘রাস্তায় সবার ধাওয়া খেয়ে পলায়নপর ইঁদুরের’ মতো টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ফলে তালিবানের সাথে শান্তি আলোচনা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের। প্রথমে আফগান তালিবান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনোভাবেই আলোচনা করতে চায়নি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ঝামেলা সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। 

আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তান নানা সমস্যা কাটিয়ে ওঠে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পক্ষের সাথে কাজ করে এবং সফলভাবে আফগান তালিবানকে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি করায়। অর্থাৎ আফগানিস্তনে শান্তি ও সমন্বয় প্রক্রিয়ার সমর্থক ও মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকা পুরোপুরি পালন ও যুক্তরাষ্ট্র-তালিবান আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধের জন্য গত ২৯ ফেব্রুয়ারি শান্তি চুক্তি সই করার কাজ করে পাকিস্তান। 

একইভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব পক্ষের সাথে মিলে আফগান সরকার ও তালিবানের মধ্যে আলোচনা শুরু করার ব্যবস্থা করতে পাকিস্তানকে অনেক কাজ করতে হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আবারো জোর দিয়ে বলেন, শান্তি ও উননয়ন নিশ্চিত করার জন্য আফগান জনগণের বিরামহীন প্রয়াসের প্রতি পাকিস্তান পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাবে। আফগান মালিকানাধীন ও আফগান নেতৃত্বাধীন শান্তি আলোচনা আফগানিস্তান ও এই অঞ্চলের শান্তি নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য বিষয়। তিনি আশা করেন, আফগান নেতারা এই সুযোগটি গ্রহণ করবে এবং অন্তর্ভুক্তমূলক, ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর জন্য একসাথে কাজ করে যাবে। 

আফগান শান্তিপ্রক্রিয়া এখনো অনিশ্চিত 

আন্তঃআফগান আলোচনা শুরু হলেও দেশটিতে শান্তি ও সমন্বয়ের প্রক্রিয়া খেনো অনেক সমস্যায় রয়েছে। 

প্রথমত, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সব সৈন্য প্রত্যাহার করেনি। আফগানিস্তানবিষয়ক বিশেষ মার্কিন দূত জালমি খালিলজাদ সম্প্রতি বলেছেন, এক থেকে দুই মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সাড়ে চার হাজারে নামিয়ে আনবে যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যরা যতক্ষণ উপস্থিতি বজায় রাখবে, আফগান তালিবান ততক্ষণ পর্যন্ত প্রতিরোধ আন্দোলন পুরোপুরি বন্ধ করবে না। আফগানিস্তানে সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন সৈন্যদেরকে অবশ্যই পুরোপুরি আফগানিস্তান ত্যাগ করতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, আফগান কর্তৃপক্ষের ওপর যুক্তরাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করবে না। তালিবান বিশ্বাস করে যে বর্তমান আফগান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়নক। বস্তুত, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না থাকলে আফগানিস্তানের বর্তমান কর্তৃপক্ষ সাথে সাথে ধসে পড়বে। 

এ ধরনের পরিস্থিতিতে আন্তঃআফগান আলোচনা যুদ্ধের পাশাপাশিই সম্ভবত অব্যাহত থাকবে এবং আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি মৌলিকভাবে বদলাবে না। আফগানিস্তানে সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই আফগান সরকারের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে হবে। 

তৃতীয়ত, একটি আঞ্চলিক শক্তি আফগান ঘটনাবলীতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে। এটি আফগানিস্তানের শান্তি ও সমন্বয় প্রক্রিয়ায় আরো জটিলতা সৃষ্টি করবে। 

লেখক: ভিজিটিং প্রফেসর, সাউথওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, পলিটিক্যাল সায়েন্সেস অ্যান্ড ল; ফেলো, চারহার ইনস্টিটিউট; সাবেক প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে, দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলো, সাবেক জাতিসঙ্ঘ সিনিয়র সামরিক পর্যবেক্ষক

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com