ইরান-চীন সম্পর্কে আতঙ্কিত ভারতের দৌড়ঝাপ

0

ভারতের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও পাকিস্তানের সাথে ইরানের সম্পর্কন্নোয়নে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে তারা। ভারতের সাথে সম্পর্ক শুরু হতে গিয়েও নিজেদের ব্যর্থতায় মুখ ফিরিয়ে নেয় ইরান। সুযোগ হারিয়ে আতঙ্কিত ভারত এখন দৌড়ঝাপ শুরু করেছে। তাই তড়িঘড়ি করে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তেহরান সফর করেন। 

তাদের এই সাম্প্রতিক তেহরান সফর বিভিন্ন ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারত ইরান-চীন সম্পর্কে আতঙ্কিত কি-না, এমন প্রশ্নও তোলা হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। গত সপ্তাহে অনেকটা নীরবেই তেহরান যান মোদী সরকারের এই দুই শীর্ষ মন্ত্রী। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তেহরানে নামেন মস্কোতে সাংহাই সহযোগিতা জোটের বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার পথে। আর জয়শঙ্কর মস্কো থেকে ফেরার পথে তেহরান নামেন।

নীরবে এই সফর নিয়ে সরকারিভাবে ‘বিমানে তেল ভরার’ নামার যুক্তি দেয়া হয়েছে। যদিও ভারতের দুই মন্ত্রী সেই তেল দুবাই বা আবুধাবিতে না ভরে তেহরানে কেন নামলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চিরশত্রু চীন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ইরান যেভাবে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তাতে ‘গভীর উদ্বিগ্ন’ ভারত।

দিল্লির জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির (জেএনইউ) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক সঞ্জয় ভারদওয়াজ বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চীনের সঙ্গে ইরানের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা বাড়ছে। ভারতের কাছে ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। ভারত কোনোভাবেই তা খোয়াতে চায় না।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই অধ্যাপক বলেন, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বাজারে ঢোকার জন্য ভারতের কাছে ইরানের গুরুত্ব বিশাল। সে কারণেই ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়নে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল ভারত। তিনি বলেন, জ্বালানির জন্য এবং কাশ্মির ইস্যুতে ইরানের মতো প্রভাবশালী একটি মুসলিম দেশের কাছ থেকে রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য ভারত উদগ্রীব।

তবে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতিতে ভারত ও ইরান যে ভিন্ন দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে তা স্পষ্ট। বিশেষ করে যে দেশটি এখন ভারতের সবচেয়ে শত্রু দেশে পরিণত হয়েছে সেই চীনের সঙ্গে ইরানের যে ব্যাপক অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে, তা ভারতের কাছে দুঃস্বপ্ন। 

তবে ইরান ও ভারতের মধ্যে দূরত্ব একদিনে তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা যত বেড়েছে, ইরানের সঙ্গে ততই দূরত্ব বেড়েছে। সেই শূন্যতা পূরণে ঝড়ের মতো ঢুকে পড়েছে চীন।

চীন এবং ইরান তাদের মধ্যে ২৫ বছরের একটি ‘কৌশলগত সহযোগিতার‘ চুক্তি নিয়ে বোঝাপড়া চূড়ান্ত করে ফেলেছে বলে জানা গেছে। নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত নানা তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, এই চুক্তিতে ইরানের তেল-গ্যাস, ব্যাংকিং, টেলিকম, বন্দর উন্নয়ন, রেলওয়ে উন্নয়ন এবং আরও কয়েক ডজনখানেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে চীন আগামী ২৫ বছরে কমপক্ষে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।

কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইরানের যে বন্দরটির উন্নয়নের শুরু ভারতের হাতে হয়েছে; সেই চাবাহার বন্দরের সম্প্রসারণ এবং ওই বন্দরের সঙ্গে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহরের রেল যোগাযোগের কাজ এখন চীনের হাতে তুলে দেয়ার কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে ইরান। জানা গেছে, চীন এখন চাবাহার বন্দরটিকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপেক) অংশ করতে উদগ্রীব।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক রাকেশ সুদ বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় চাবাহার বন্দর উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি পূরণে ভারতের গড়িমসিতে ইরান ক্ষুব্ধ। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে এশিয়ায় জোট রাজনীতির আমূল পরিবর্তনের প্রভাব। 

রাকেশ সুদ বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে রাশিয়া এবং চীনের দৃষ্টিভঙ্গি এখন একইরকম। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তান, ইরান এবং তুরস্ক। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যেসব দেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে-ইউএই এবং সৌদি আরব, তারা ইরানের বড় শত্রু।’

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের আগ্রহে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কে যেভাবে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে তা ভারতের জন্য বাড়তি মাথাব্যথা। কারণ, ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে ভারত তাদের প্রভাব কতটা ধরে রাখতে পারবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর।

মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেন্টারের আয়োজনে গত মাসের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তান নিয়ে এক অনলাইন আলোচনায় সেদেশের প্রখ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, প্রধানত অর্থনৈতিক স্বার্থে ইরানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে পাকিস্তানের ভেতর আগ্রহ বাড়ছে। 

তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের স্বার্থকে নতুন করে পর্যালোচনা করছে এবং পাকিস্তানের চাইতে ভারত তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইরান এখন পাকিস্তানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’

তাহলে ভারত কি তাদের এক সময়কার ঘনিষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু দেশে ইরানকে একেবারেই হারিয়ে ফেলছে-এমন প্রশ্নে অধ্যাপক ভারদওয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র নাখোশ হবে তা জেনেও দুজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে তেহরানে পাঠিয়ে ভারত বোঝাতে চেয়েছে যে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ককে তারা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারত বার্তা দিতে চাইছে যে, পররাষ্ট্রনীতি এবং কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে দিল্লির নীতি এখনও স্বাধীন। এ ব্যাপারে তারা আপসহীন।’

তিনি বলেন, ভারতের মতো বড় একটি বাজার সবসময়েই ইরানের জন্য লোভনীয় এবং ইরান নিশ্চয়ই জানে যে, তাদের জ্বালানি তেলের পুরোটাই চীন কিনবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের রেষারেষিকে কেন্দ্র করে এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে যে দলাদলি শুরু হয়েছে ভারত-ইরান সম্পর্ক যে তার বলি হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com