আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা পাল্টে দেয়ার মতো সামরিক শক্তি এখন আছে চীনের

0

পূর্ব লাদাখে চীন কেন ভারতের সাথে নতুন করে সামরিক সঙ্কটকে ত্বরান্বিত করছে? দিল্লীতে যে বহু ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চালু আছে, তার মধ্যে সবসময় সহজ আর আকর্ষণীয় একটা উত্তর রয়েছে – সেটা হলো এর কারণ হলো আমেরিকা। যুক্তিটা হলো, দিল্লী ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার মাধ্যমে বেইজিংয়কে ক্ষুব্ধ করেছে। এতে বলা হচ্ছে, মার্কিন-নেতৃত্বাধীন কোয়াডে ভারত নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার কারণে দিল্লীকে শিক্ষা দিতে চাইছে চীন।

চীনের সাথে অন্যান্য যে সব দেশের সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব কতটা প্রযোজ্য হবে? দক্ষিণ চীন সাগরের দিকে তাকানো যাক, চীন সেখানে বিতর্কিত জলসীমায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্য জোরালো ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভূখণ্ডগত বিবাদ নিয়ে বেইজিং আর জাকার্তার বিবাদের বিষয়টি নিয়ে যে উত্তেজনা বাড়ছে, সেটির কথাই বিবেচনা করা যাক।

দুই দেশের ভেতরের আঞ্চলিক বিবাদ নিয়ে কথা বলাটা অদ্ভুত কারণ দুই দেশ একে অন্যের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। দূরত্বের কারণে বেইজিয়ের সাথে বিবাদ এড়ানো যাবে, এ ধরনের কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া যাবে না, অন্তত দক্ষিণ চীন সাগরে সেটা সম্ভব নয়। যেমন, জাকার্তা বলেছে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের সাথে তাদের কোন আঞ্চলিক বিবাদ নেই। কিন্তু এর পরও একটা সমস্যা রয়ে গেছে।

আপনি হয়তো কোন সমস্যাকে ডেকে আনতে চান না, কিন্তু সমস্যা সব সময় নিজ থেকেই আপনার দরজায় এসে নক করবে, বিশেষ করে সেখানে যদি কোন পরাশক্তি জড়িত থাকে। ঈশপের গল্পের কথা স্মরণ করুন, যেখানে নেকড়ে এসে একটা মেষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো যে, সে তার পানি দূষিত করছে। মেষ তার প্রতিবাদ করে বলেছে যে ভাটির দিকে সে শুধু পানি খেয়েছে, কোন দূষিত করেনি, কিন্তু অবশ্যই তাতে করে নেকড়ে তাকে ছেড়ে দেয়নি এবং তাকে খেয়ে ফেলেছে।

গত এক বছর এবং তার কিছু বেশি সময় ধরে জাকার্তা তাদের নাটুনা দ্বীপপুঞ্জের কাছে চীনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। নাটুনা চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১,৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। হাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন – দূরত্বটা ১,৫০০ কিলোমিটার। দক্ষিণ চীন সাগরের প্রায় ৮০ শতাংশ অঞ্চল নিজেদের দাবি করে বেইজিং যে নয়টি ড্যাশলাইন টেনে দিয়েছে, নাটুনা তার মধ্যেও পড়ে না। বিবাদ হলো বিশেষ অর্থনৈতিক জোন নিয়ে যেটা ইন্দোনেশিয়াকে অর্পন করছে দ্বীপগুলো।

চীন বলেছে যে, এই জলসীমায় তাদের ঐতিহাসিক অধিকার রয়েছে এবং সেখানে তারা তাদের মাছ ধরার বহর পাঠাচ্ছে। জাকার্তা সব ধরনের চেষ্টা করেছে – অব্যাহতভাবে কূটনৈতিক আপত্তি জানানোর পাশাপাশি গত সপ্তাহে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছি চিঠিও দিয়েছে। দ্বীপপুঞ্জের উপর জাকার্তার সার্বভৌমত্বের বিষয়টি প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানে প্রেসিডেন্ট সফর করেছেন, এবং মাঝে মধ্যে চীনের মাছ ধরার বোটও ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই সব কিছু বেইজিংয়ের উপর সামান্যই প্রভাব ফেলেছে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র দ্ব্যর্থহীনভাবে এই বিষয়টাকে তুলে ধরেন চলতি বছরের শুরুর দিকে, যখন বিষয়টি সামনে এসেছিল: “ইন্দোনেশিয়ান পক্ষ স্বীকার করুক বা না করুক, তাতে করে এই বাস্তবতার কোন পরিবর্তন হবে না যে, এই সংলগ্ন জলসীমায় চীনের অধিকার ও স্বার্থ রয়েছে”।

আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর সাথে সীমানাগত বিবাদ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া সচেতনভাবে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছে। এর মধ্যে একদিকে রয়েছে ভিয়েতনাম আর ফিলিপাইন্স, অন্যদিকে রয়েছে চীন। দক্ষিণ চীন সাগরের বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করে আসছে জাকার্তা। হয়তো চীন জাকার্তা-ওয়াশিংটন সম্পর্ককে একটা সমস্যা হিসেবে দেখছে।

জাকার্তা ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলকে সমর্থন দেয়নি এবং নিজেদের মতো একটা ধারণা তৈরি করেছে এবং আসিয়ান সদস্যদের কাছ থেকে সেটার অনুমোদনও করিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া বহুল-সমালোচিত কোয়াডেরও সদস্য নয়। পররাষ্ট্র নীতিতে তারা জোট নিরেপক্ষতার নীতি অনুসরণ করে। এবং ১৯৫৫ সালে ঐতিহাসিক বানদুং সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে ইন্দোনেশিয়া জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরিচিত।

এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরনো সামরিক মিত্রদের একটি ফিলিপাইনের গল্পটি চমৎকারভাবে চীনের সাথে জোট-নিরপেক্ষ ইন্দোনেশিয়ার সমস্যাকে পূর্ণ করেছে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট রোডরিগো দুতের্তে যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব তৈরি করে চীনের ঘনিষ্ঠ হন, যাতে বেইজিংয়ের সাথে আঞ্চলিক সীমানাগত বিবাদগুলো যথাযথভাবে মিটিয়ে ফেলা যায়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে, ম্যানিলা সেই চুক্তিটি বাতিল ঘোষণা করেছে, যে চুক্তির অধীনে আমেরিকান সেনারা ফিলিপাইনে কাজ করতে পারে। কিন্তু গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা বাতিলের সিদ্ধান্তটি স্থগিত করে। এর কারণ হলো: দক্ষিণ চীন সাগরের কিছু দ্বীপ – যেগুলোকে ম্যানিলা নিজেদের দাবি করে, সেখানে পিএলএ অব্যাহত চাপ সৃষ্টি করছে এবং সেগুলোকে চীনের নতুন একটি প্রশাসনিক জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জোট-নিরপেক্ষ জাকার্তা বা যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে আগ্রহী ম্যানিলার কেউই চীনের আঞ্চলিক বিবাদের পেশিবহুল আচরণ থেকে রেহাই পায়নি।

বুদ্ধিজীবীরা চীনের আচরণের উৎস নিয়ে যুক্তিতর্ক করতে পারেন, তবে সাধারণ মানুষ তাদের কমন সেন্স থেকে সাদা চোখে দেখা উত্তর দিতে পারে। একটি হলো সঠিক বা ভুল হোক, প্রতিবেশী দেশগুলোর সীমানার উপর চীনের দীর্ঘদিনের দাবি রয়েছে। অন্যটি হলো চীনের অনুকূলে আঞ্চলিক ক্ষমতা ভারসাম্য নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। চীনের এখন এমন সামরিক ক্ষমতা হয়েছে যে, তারা আঞ্চলিক সীমানাগত স্থিতাবস্থা বদলে দিতে পারে, সেটা যদি সামান্য পরিমাণেও হয়। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন সেটাই করছে। লাদাখের পরিস্থিতিটিও এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়।

উত্তর ভারতের একজন সাধারণ ভারতীয় যেভাবে দেখে, সেটা হলো “জিসকি লাঠি, উসকি ভাইনস” (বড় লাঠি যার, মহিষটা তার)। গ্রিক দার্শনিক থুসাইডাইডসও একই কথা বলেছেন: “শক্তিধরেরা যেটা পারে, সেটা তারা করে, আর দুর্বলদেরকে অবশ্যই সেখানে ভুগতে হবে”।

দিল্লীর আসল চ্যালেঞ্জ হলো বেইজিংয়ের সাথে বিশাল সীমানাগত বিরোধের মীমাংসা করা, এবং এর পর চীনের সাথে ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতাকে ঠিক করা। বাকিটা ইতিহাস।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com