ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করতেই হবে
এই পুজোয় দুটো চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। কলকাতার একটি পুজোমন্ডপে আজানের আওয়াজ ব্যবহার করা হয়েছে। এবং কলকাতার একটি পুজোয় এক মুসলমান সাংসদ সিঁথিতে সিঁদুর পরে তাঁর হিন্দু স্বামীর সংগে ঢাক বাজিয়েছেন, অঞ্জলি দিয়েছেন, এবং প্রার্থনাও করেছেন। দুটি ঘটনাকেই বলা হচ্ছে, ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য করা।
কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলে যে পুজোয় আজানের আওয়াজ বাজানো হয়েছে, সেই পুজোয় উদ্যোক্তারা বলেছেন সব ধর্মের মধ্যে ‘সম্প্রীতির বার্তা’ পৌঁছে দিতেই তাঁরা এবারের পূজার ‘থীম’ করেছেন ‘আমরা এক, একা নই’। মন্ডপ সজ্জায় তাঁরা যেমন হিন্দু-ইসলাম-খ্রিস্টান সব ধর্মের নানা মোটিফ তুলে ধরেছেন, তেমনই থীম সংগীতে চন্ডীপাঠের সঙ্গে আজান, বাইবেল পাঠ এবং চার্চের ঘণ্টাধ্বনি ব্যবহার করেছেন। এতে সাধারণ মানুষের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু হিন্দু কট্টরপন্থী কিছু লোকের বড় আপত্তি। তাঁদের কথা, ‘হিন্দুদের পূজার মন্ডপ থেকে আল্লাহু আকবর বাজছে। কোনও চার্চে ক্রিসমাস ক্যারলের সময়ে নিশ্চই গায়ত্রী মন্ত্র বাজানো হবে না, অথবা ঈদের দিন কোনও মসজিদে নিশ্চয়ই হনুমান চালিসা পাঠ হয় না! আমরা চাইও না সেরকমটা হোক- তাতে শুধু অশান্তিই বাড়বে। সবাই নিজের মতো করে নিজের ধর্ম পালন করুক না কেন! তা ছাড়া দুর্গাপূজার প্রথমেই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়, অর্থাৎ পূজার চারদিন সেটা হিন্দুদের কাছে মন্দিরের সমতুল্য। সেখানে আজান বা অন্য যে কোনও ধর্মের ধ্বনি কেন বাজানো হবে? থীমের নামে যা খুশি তো করা যায় না!’কিছু মুসলিম কট্টরপন্থীও পছন্দ করেননি পুজোয় আজানের ধ্বনি বাজানো। বলেছেন, ‘এভাবে সম্প্রীতির সেতু বানানো যায় না।’ কিছু হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। মসজিদের ভেতরে যদি মা দুর্গার প্রশংসাসূচক কোনও গান পরিবেশিত হয়, সেটা যেমন আপত্তিকর, একইভাবে দুর্গাপূজার মন্ডপে অন্য ধর্মের কিছু বাজানো হলেও তাদের আপত্তি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক! এভাবে সম্প্রীতি রক্ষা হয় না, উল্টো ধর্ম নিয়ে আরও অশান্তি পাকিয়ে ওঠে।’
কিন্তু হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ বলছেন তাঁদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগেনি মোটেও। বরং সম্প্রীতির বার্তা তাঁদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। তাঁদের ভাষ্য, ‘চন্ডীপাঠ, বাইবেল পাঠ, আজান সব মিশেছে এক সংগে। দুর্গাপুজো সর্বজনীন পুজো, সর্বজনীন মানে সবার জন্য। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবার জন্য শারদীয় উৎসব। হিন্দুদের গঙ্গাসাগর মেলা বা কুম্ভ মেলায় যেমন বহু মুসলমান যান, তেমনই অন্য ধর্মের মানুষও তো দুর্গাপুজোর উৎসবে সামিল হন। একে অপরকে যদি মানুষ হিসাবে ভালো না বাসতে পারি, তাহলে আর কীসের ধর্ম!’
কট্টরপন্থী নন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চান, এমন দু’একজন বিশ্বাস করেন না পুজোয় আজান বাজিয়ে বা মসজিদে মন্ত্র পড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তৈরি হবে। তাঁরা বলছেন, ‘এই কলকাতা শহরেই দুই ধর্মের মানুষ পাশাপাশি রয়েছেন অনেক শতাব্দী ধরে- কিন্তু একে অপরের ধর্মীয় রীতিনীতি সম্বন্ধে বেশি কিছু জানে না কেউ। উদ্যোক্তারা সত্যিই যদি দুই ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি করতে চান, তাহলে উচিত হবে দুর্গাপূজায় মুসলমানদের ডেকে নিয়ে এসে দুর্গাপূজাটা কী, কীভাবে হয়, কালীপূজায় কী কী হয়, সেসব বোঝাতে পারতেন। আবার একইভাবে মুসলমান সমাজের নেতাদেরও উচিত হিন্দুভাইদের আহ্বান করে এনে রোজা, ঈদ, আজান- এসবের ব্যাপারে অবগত করানো। একে অপরকে জানলে বুঝলেই তৈরি হবে সম্প্রীতির সেতু।’
উদ্যোক্তাদের মতে যারা তাঁদের পুজোর থীমের বিরোধিতা করছে, তারা সম্প্রীতির পরিবেশটা নষ্ট করতে চাইছে, তারাই যেন হয়ে উঠছে দুর্গাপুজোর আসল অসুর। ওদিকে একই শহরে নুসরাত জাহান, বাংলা সিনেমার অভিনেত্রী, তৃণমূলের সাংসদ, নিজে মুসলমান হয়ে নিখিল জৈন নামের এক অ-মুসলিম ব্যবসায়ীকে সম্প্রতি বিয়ে করেছেন। বিয়ে মুসলমান এবং হিন্দু- এই দুই ধর্মের রীতিনীতি মেনেই হয়েছে। লোকসভার অধিবেশনে নুসরাত জাহান যখন প্রথম গেছেন সাংসদ হিসেবে, তাঁর সিঁথিজুড়ে ঘন সিঁদুর, গলায় মঙ্গলসূত্র। নুসরাত কি ধর্মান্তরিত হয়েছেন? মুসলমান থেকে হিন্দু হয়েছেন? না তা হননি। নুসরাত বলেন, ‘আমি একটি সমন্বিত ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করছি, যা জাতপাত ও ধর্মের বাধার অনেক ঊর্ধ্বে। আমি এখনও একজন মুসলিম। আর আমি কী পরব বা পরব না এই নিয়ে কারোরই কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়। আস্থা পোশাক পরিচ্ছদের অনেক ঊর্ধ্বে, এটা পুরোটাই বিশ্বাস। সকল ধর্মের মূল্যবান মতবাদ নিজের মতো করে চর্চা করার উপরেই নির্ভর করে। যেকোনো ধর্মের উগ্র মানসিকতার মন্তব্যে কান দেওয়া বা উত্তরে প্রতিক্রিয়া প্রদান করা কেবল ঘৃণা ও হিংসার সৃষ্টি করে। ইতিহাস এর সাক্ষী।’
নুসরাতের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন দেওবন্দের দারুল উলুম মাদ্রাসার ইমাম মুফতি আসাদ কাশমি। তাঁর বক্তব্য মুসলমান শুধু মুসলমানকেই বিয়ে করতে পারেন। নুসরাত নিজে মুসলমান হয়ে মুসলমানকে বিয়ে করেননি। অমুসলমানকে বিয়ে করেছেন, তার ওপর সিঁদুর আর মঙ্গলসূত্র পরছেন, এমন কাজ ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। নুসরাত এসব পরোয়া করেন না। তিনি বারবারই উত্তর দিয়েছেন এই বলে যে তিনি সমন্বিত ভারতের প্রতিনিধি। নুসরাত তাঁর স্বামীকে নিয়ে নিজামুদ্দিনের দরগায় গিয়েছেন, খাজা বাবার মাজারে গিয়েছেন, একই রকম সিঁদুর পরে দুর্গা পুজোয় অঞ্জলি দিয়েছেন। চোখ বন্ধ রেখে হাতজোড় করে অঞ্জলির মন্ত্রপাঠ ও প্রার্থনা করেছেন। সব ধর্মকেই তিনি শ্রদ্ধা করেন। এবারের পুজোয় ঢাক বাজিয়েছেন, অঞ্জলি দিয়েছেন, এমনকী ইছামতীর নদীতে দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনও দেখতে গিয়েছেন। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবংগের মানুষ একই নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেন, এই দৃশ্য অভূতপূর্ব। এই দৃশ্য দেখেও নুসরাত অভিভূত। নুসরাতের আচরণ দেখে হিন্দু কট্টরপন্থীরা অখুশি না হলেও মুসলিম কট্টরপন্থীরা ভীষণ অখুশি। কেউ কেউ বলছেন, ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসের আসাম রাজ্যের আইটি সেলের এক কর্মী নুসরাতকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতি আসাদ কাশমি বলেন, ‘নুসরাত হিন্দু দেবতাকে পূজা দিচ্ছেন, যদিও ইসলামের অনুসারীদের প্রতি নির্দেশ রয়েছে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারও উপাসনা না করার। তিনি যা করেছেন তা হারাম।’
এই উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান কত শতাব্দী ধরে এক গ্রামে, এক শহরে বাস করছেন। তারপরও সম্প্রীতি কিন্তু তাদের মধ্যে যথেষ্ট নেই। বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমানের সংস্কৃতি এক হলেও বাঙালি মুসলমানরা আরবের সংস্কৃতি গ্রহণ করতে চান, বাঙালি হিন্দুরা চান উত্তর-ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করতে। বাঙালি মুসলমান আরবদের মতো পোশাক পরছেন, ধর্মান্ধতার দিকে ঝুঁকছেন, বাঙালি হিন্দু তলোয়ার হাতে নিয়ে রাম নবমীর মিছিল করছেন, মুসলমানদের শত্রুজ্ঞান করছেন আর বাংলা ভুলে গিয়ে হিন্দি আওড়াচ্ছেন। বাঙালিয়ানাকে বাঙালিরা জেনেশুনে বিসর্জন দিচ্ছেন।
বাঙালি মুসলমানের পূর্ব-নারী এবং পূর্ব-পুরুষ এক সময় বাঙালি হিন্দুই ছিলেন। ভারতবর্ষে বহিরাগত মুসলমানরা আসার পর অনেক হিন্দুই তাঁদের সংস্পর্শে এসে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হন। ইসলামে জাত প্রথা নেই বলে তথাকথিত নীচু জাতের অনেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। খ্রিস্টানরা এসেও ধর্মান্তরিত করেন গরিব এবং নীচু জাত বলে যারা সমাজে অবহেলিত এবং নির্যাতিত, সেই হিন্দুদের। হিন্দুরা হিন্দু ধর্মের উৎসবকে যতই সর্বজনীন আখ্যা দিন না কেন, জাতপ্রথাকে নিশ্চিহ্ন না করলে, নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত না করলে এই ধর্ম আধুনিক সমাজে গ্রহণযোগ্য হবে না। মৌলবাদী দুই ধর্মেই বাড়ছে। মুসলমানকে সহনশীল হতে হবে। মুসলমানরা হিন্দুকে বিয়ে করলে, তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়া বন্ধ করতে হবে। অনেক হিন্দুও মুসলমানকে বিয়ে করা একেবারে বরদাস্ত করতে পারে না। নিজেকে উদার করতে হবে, নিজের মন মানসিকতাকে উন্নত করতে হবে, সভ্য হতে গেলে সহিষ্ণু হতেই হয়। এই বাংলায় হিন্দু আর মুসলমানকে আরও বহু শতাব্দী পাশাপাশি বাস করতে হবেই। হিন্দুকে এবং মুসলমানকে এপার বা ওপার বাংলা থেকে পুরোপুরি বহিষ্কার করে দেওয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়। পাশাপাশি বাস করতে হলে ধার্মিকদের উদার হওয়া ছাড়া বা সহিষ্ণু হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ভারতবর্ষ একবার ভাগ হয়েছে, বারবার ভাগ হবে না। একবিংশ শতাব্দী টুকরো টুকরো হওয়ার জন্য নয়, বরং এক হওয়ার জন্য। এক না হলে ঘৃণা, দাংগা, কোপাকুপি, রক্তারক্তি, আর হাহাকার লেগেই থাকবে। এসব কোনও সুস্থ মানুষ চায় না।