বাংলাদেশে আসলে সত্যিকার পরিস্থিতিটা কি?
বাংলাদেশে আসলে সত্যিকার পরিস্থিতিটা কি? করোনা ভাইরাসের ব্যাপকতাই কতটুকু? সরকার বলছে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে। পশ্চিমা মিডিয়া বলছে আগামী দুই সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। স্থানীয় মিডিয়ার কাছেও এরকম খবর রয়েছে। কিন্তু তা নানা কারণে সামনে আসছে না। বিদেশি কূটনীতিকদের দলে দলে ঢাকা ছাড়ার মধ্য দিয়ে আশঙ্কা আরো জোরালো হয়েছে। কত লোক এ মারাত্মক ছোঁয়াছে রোগে মারা যাবেন এমন কোনো ধারণা আমাদের কাছে নেই। জাতিসংঘের একটি রিপোর্ট থেকে সবাই উদ্ধৃতি দিচ্ছেন, ইশারা-ইঙ্গিতে। আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন? তারা তো একটা ধারণা দিতে পারতেন।
টিভিতে তারা যা বলছেন তা বিশ্লেষণ করলে এটাই দাঁড়ায়, সব আয়ত্বের মধ্যেই রয়েছে, ভালো কথা। পৃথিবীর খুব কম দেশই এমন ধারণা দিয়ে যাচ্ছে জনগণকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার জনগণকে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজেই ঝুঁকিতে। ব্যক্তিগত চিকিৎসক তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন তিনদিন আগে। এই চিকিৎসক এখন করোনায় আক্রান্ত। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কোয়ারেন্টিনে। মৃত্যু হানা দিচ্ছে দেশে দেশে। ৪২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে অনেকে বলছেন প্রতি একশ বছর পর পৃথিবী এমন দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। বাংলাদেশে আমরা লকডাউনের সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছি। বলছি সাধারণ ছুটি। মৌলিক কোনো পার্থক্য না থাকলেও মানুষজনকে কিভাবে আটকে রাখবেন। ঢাকার রাস্তায় গত দুইদিনে যানচলাচল অনেক বেড়েছে। কারণে-অকারণে অনেকে রাস্তায় বের হচ্ছেন। এটা ভালো লক্ষণ নয়। এমন শিথিল অবস্থা চলতে থাকলে যানবাহন বেড়ে যাবে। মানুষজন পার্ক বা হাতিরঝিলে ভিড় জমাবে। নীতি নির্ধারকরা কি ভাবছেন জানি না। তবে জেলা প্রশাসকরা যেভাবে সরকার প্রধানের সামনে অবস্থা বর্ণনা করেছেন তাতে মনে হয় দেশে কোনো সংকট নেই। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে তবুও কেন অঘোষিত লকডাউন?
সকালে একজন জেলা প্রশাসক বললেন, তার জেলা মুক্ত। রাতেই একজন রোগী তার জেলায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি হয়তো বলবেন, সর্দি-জ্বর বা হাঁপানিতে মারা গেছেন। ইদানীং এটাই বলা হচ্ছে। চিকিৎসকরা যেন তাদের বিবেক-বুদ্ধি, আদর্শ ভুলে গেছেন। জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের ধারণাটা ভালো। কিন্তু সেখান থেকে যে বার্তা সরাসরি জনগণকে পৌঁছে দেয়া হয়েছে তা কেন জানি ভুল বার্তা হিসেবেই বিবেচিত হবে আখেরে। কারণ মানুষ ভাবছে সব স্বাভাবিক। তাহলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া যায়। সরকার সতর্ক থাকবে এটা তো স্বাভাবিক। মানুষকে বাঁচাবে সর্বশক্তি দিয়ে। সে যে ধরণের সরকারই হোক না কেন?
মিডিয়া বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে বিপদ বাড়ে বরং কমে না। দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে মিডিয়া ভূমিকা রাখে। করোনা ভাইরাস রুখতে অবশ্যই মিডিয়া থাকবে অগ্রণী ভূমিকায়। কোথায় কি ঘটছে তা জানতে না পারলে কৌশল ঠিক করবেন কিভাবে? মূলধারার মিডিয়া যদি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় তখন ‘ফেক নিউজ’ সেই শূন্যস্থান দখল করবে। এমনটি হলে বিপদ কি হবে তা একবার আন্দাজ করুন। ইন্টারনেট বন্ধ বা গতি স্লথ করা হবে আরেকটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় দপ্তর থেকে প্রতিদিন যে খবর দেয়া হচ্ছে তা বিশ্লেষণ করলে যে কেউ ধারণা করতে পারেন বাংলাদেশ করোনা নির্মূলে এক অনুকরণীয় মডেল। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তা বলে না। রোগ নির্ণয়ে আইইডিসিআর প্রতিনিয়ত ভুল তথ্য দিচ্ছে। একজন মৃত মানুষের দেহে কতসময় জীবাণু বা এজেন্ট থাকতে পারে তা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অথচ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা নিজেরাই একটি গাইডলাইন বানিয়ে ফেলেছেন। সরকারের করোনা বিষয়ক মুখপাত্র ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিজেই মিডিয়ার কাছে কবুল করেছেন, আসলে কোনো গাইডলাইন নেই। বিভিন্ন গবেষণাপত্র ঘেঁটে তারা ঠিক করেছেন, কোনো ব্যক্তি মারা যাওয়ার দশ থেকে বারো ঘণ্টার মধ্যে টেস্ট করলে জানা যাবে তিনি কোন রোগে মারা গেছেন। আমরা কি দেখছি? আমরা দেখছি, মারা যাওয়ার একদিন পর আইইডিসিআরের লোকজন হাসপাতালে গিয়ে হাজির হচ্ছেন। এতে করে প্রকৃত সত্য জানা যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, টেস্ট, টেস্ট আর টেস্ট। বাংলাদেশ সবকিছু মানলেও কেন জানি এই টেস্টের ব্যাপারে এক ধরণের অনীহা। চাইনিজ টেস্টিং কিট নিয়ে দেশে দেশে নানা প্রশ্ন। ইউরোপের অনেক দেশ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশের সামনে বিকল্পই বা কি? মার্কিন আদালতে চীনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগে মামলা হয়েছে।
এখনতো মিডিয়া খবর দিচ্ছে চীনের উহানে ৩৯ হাজার মানুষ করোনায় মারা গেছে। শুরুটা উহান থেকেই। শেষ হবে কোথায় আল্লাহমালুম। তাবলীগের অনুমতি দিয়ে ভারত সরকার বিপদে। ইতিমধ্যে এ জামাতে অংশ নেয়া তিনশ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের সন্ধান মিলেছে। এই জামায়াত থেকে ফিরে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এখনও জুমার নামাজের ব্যাপারে স্বচ্ছ কোনো নির্দেশনা দেয়নি। মক্কা-মদিনায় যেখানে জামায়াত বন্ধ রেখেছে সেখানে বাংলাদেশ কেন এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তা বলা সত্যিই কঠিন। যদিও রাজধানীতে গুলশান সোসাইটির মসজিদসহ বেশকিছু মসজিদে জুমার নামাজ বন্ধ রয়েছে।
শেষ কথা: ঘরে থাকুন। সরকার আপনার ভাল’র জন্যই এই নির্দেশ দিয়েছে। আপনি বাঁচুন। অন্যকে বাঁচতে সহায়তা করুন। এই সঙ্কটময় মুহুর্তে কোন কোন হাসপাতালের ভূমিকা দু:খজনক। খবর রয়েছে সাধারণ সর্দি কাশির রোগীও হাসপাতালগুলো গ্রহণ করছে না। বরং উল্টো নিরাপত্তা কর্মী লেলিয়ে দিচ্ছে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, দৈনিক মানবজমিন।
সংগৃহিত