করোনা মোকাবিলায় যেন ডেঙ্গুকে ভুলে না যাই
চোখে দেখা যায় না, এ ধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু, ভয়ানক ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) আক্রমণে বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব স্তম্ভিত, উদ্বিগ্ন, বিচ্ছিন্ন ও স্থবির। করোনার সর্বগ্রাসী বিস্তার, সংক্রমণ এবং শক্তি মনুষ্যসৃষ্ট যে কোনো মারণাস্ত্রকে হার মানিয়ে বিশে^র প্রায় প্রতিটি দেশ, জাতি, জনপদ ও মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে করোনাভাইরাস মিউটেশনে রূপ বদলায় এবং পরিবেশ পেলে বিধ্বংসী হয়। এতে রূপান্তরিত জিনের অংশ থাকায় সুপ্ত প্রোটিন সতেজ করতে হলে ভাইরাসকে শরীরে ঢুকতে হয়। ফিউরিন নামক এনজাইম সুপ্ত প্রোটিনকে সতেজ করে। ভাইরাস ফিউরিনকে আক্রমণ করে প্রোটিনকে সতেজ করে। এ ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় ভাইরাস ও মানবকোষের সংমিশ্রণ ঘটে এবং রোগের বিস্তার করে। রোগটি যে কত বিধ্বংসী তা বিশ^ব্যাপী মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। তারপর এ পর্যন্ত (২৬ মার্চ, ২০২০) বিশে^র ১৯৮টি দেশে ৪ লাখ ৭১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং ২১ হাজার ২৯০ জনের বেশি মৃত্যুবরণ করেছে। সংক্রমণের কেন্দ্র চীনে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮১ হাজার ২৮৫ এবং তার মধ্যে ৬৭ হাজার ৮০০ জনের অধিক উহান শহরের। যেখানে প্রথম ভাইরাসটি শনাক্ত করা হয়েছিল, সেই শহরে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে মাত্র একজন ছাড়া আর কোনো নতুন সংক্রমণ হয়নি বলে চীন দাবি করেছে। ঘটনার সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গেই উহান শহরকে প্রথমে এবং পরে হুবেই প্রদেশকে অবরুদ্ধ করে সমগ্র দেশকে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছিল চীন। আর তা সম্ভব হয়েছিল চীনের কর্তৃত্ববাদী চরিত্র, সুদূরপ্রসারী চিন্তা, কঠোর পরিশ্রম ও বিপুল সম্পদ বিনিয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু চীন থেকে এরই মধ্যে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ভাইরাসটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বিশ্ব বর্তমানে দিশাহীন এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। চীনের বাইরে ইতালি, স্পেন, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় সংক্রমণের ব্যাপ্তি ও ভয়াবহতা উদ্বেগজনক। ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণের ভয়াবহতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাস নামক অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা সব চেষ্টা করেছি, আমরা ব্যর্থ! এখন বাকিটা আকাশে যিনি বসে আছেন উনার হাতে।’ বুঝতে কষ্ট হয় না যে, ইতালিতে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ তাদের ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় তা এখন দেখার অপেক্ষায়। এসব পরাশক্তি, উন্নত ও সম্পদশালী দেশ যদি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এত অসহায় হয় তাহলে বাংলাদেশের জনগণের জন্য তো স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তার বিষয় হবে।চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক যোগাযোগ ও ভৌগোলিকভাবে অদূরবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের করোনাভাইরাস সম্পর্কে উদাসীনতা, নীরবতা ও দায়িত্বহীনতা ক্ষমার অযোগ্য। চীনে করোনাভাইরাস চিহ্নিত হওয়া ও সংক্রমণের বিস্তার দেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা এ বিষয়ে আগে থেকেই সব দেশকে সতর্ক করেছিল। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কোনো কর্ণপাত করেনি। ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তারিখে চীনের উহান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার পর কোয়ারেন্টাইন পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও ঘাটতি প্রকাশিত হওয়ার পরও সরকার সেগুলো কাটিয়ে ওঠার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সরকার এতই উদাসীন ছিল যে, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ঢাকা-কুনমিং আকাশপথ খোলা রেখেছিল। টেস্টিংয়ের পরীক্ষাগার, কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল প্রস্তুত করার কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। ৩ মার্চ, ২০২০ তারিখে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দিশাহীন বিশ্ব, চীনসহ ৭৫টি দেশে ৯১ হাজার আক্রান্ত ও বিশ্বে ৩ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, তখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ১০০ বছরে একবার আমরা পাব। যেহেতু দেশে এখন পর্যন্ত একজনও করোনা রোগী পাওয়া যায়নি, কাজেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের কোনো অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে না।’ এর পর থেকেই জনগণের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে, মুজিবর্ষের মূল অনুষ্ঠান ১৭ মার্চ পালনের জন্য করোনা মহামারী সম্পর্কে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই তথ্য গোপন করেছে এবং বিমান চলাচল বন্ধসহ দৃশ্যত প্রস্তুতি গ্রহণে সময়োপযোগী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
করোনা মহামারী সম্পর্কে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর লাগামহীন বক্তব্যের ফলে জনমনে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই জনগণ একাদশ সংসদে ভোট থেকে বঞ্চিত হয়ে সরকারের প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ। করোনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘করোনা যত বড় শক্ত হোক, আমরা তার চেয়েও শক্তিশালী।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘করোনা বিধ্বংসী রোগ নয়, ফ্লু ও জ¦রের মতো।’ তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাংলাদেশ উন্নত দেশসমূহ থেকে বেশি প্রস্তুত।’ নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জনগণকে আরও আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, ‘দেশে শেখ হাসিনা থাকতে করোনাভাইরাস আমাদের কিছুই করতে পারবে না।’ স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রামক ব্যাধি, তবে বিধ্বংসী রোগ নয়।’ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষ যখন বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের তান্ডব ও শক্তি দেখছে, তখন সরকারের মন্ত্রীদের দায়িত্বহীন ও অসার বক্তব্য জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম ঘুম ভাঙে ৭ মার্চ, ২০২০ তারিখে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘বাংলাদেশ যে কোনো সময় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে’ তখন সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল দেড় লাখের বেশি। ১১ মার্চ, ২০২০ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস জেনেভায় অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে ভাইরাসের সংক্রমণের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা উদ্বেগজনক বলে বিশ^বাসীকে অবহিত করেন। এরই প্রেক্ষাপটে দেশের সর্ববৃহৎ দল বিএনপি করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সরকারের উদাসীনতার সমালোচনা করে সংবাদ সম্মেলন করে। ১৩ মার্চ, ২০২০ তারিখে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাদের দলীয় কার্যালয়ে এক সভায় করোনা নিয়ে বিএনপি নোংরা রাজনীতি করছে বলে মন্তব্য করেন। বিশ্ব যখন দল-মত-গোষ্ঠী নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে করোনা মোকাবিলা করছে, তখন সরকারদলীয় সাধারণ সম্পাদকের এহেন মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক।
করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের বিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ হতাশাজনক। সবচাইতে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এ ভাইরাস মোকাবিলায় নমুনা পরীক্ষা (টেস্ট) করার মতো মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান ‘আইইসিডিআর’কে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। করোনাভাইরাস নমুনা পরীক্ষা করার জন্য সরঞ্জাম (কিট) ১ হাজার ৭৩২টি মজুদ আছে বলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে। ফলে এই একটি কেন্দ্র সীমিতভাবে পরীক্ষা করার কাজ করছে। ভিড় এড়ানোর জন্য ‘আইইডিসিআর’ তাদের হটলাইনে টেলিফোন করে রোগী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে। ২২ মার্চ, ২০২০ তারিখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, সারা দেশে আরও আটটি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এবং তার জন্য ১০ থেকে ১২ দিন লাগবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন আক্রান্ত দেশে পরীক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য মাত্র একটি পরীক্ষা কেন্দ্র! যেখানে দিনে গড়ে ২৫-৩০ জন রোগীর বেশি নমুনা পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় আড়াই মাস পাওয়ার পরও দেশে পর্যাপ্ত মানসম্মত পরীক্ষাগার প্রস্তুত এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় কিট কেন আমদানি করা হলো না, তার জবাব কে দেবে? টেস্টের পরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কোয়ারেন্টাইনের কার্যকর পদক্ষেপ। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারী আকার ধারণ করার পরও আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দর খোলা রাখা হয়েছিল। এ সময়ে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিগত ১৫ দিনে এসেছে ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি এবং পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৪৬৯ জনকে। কোয়ারেন্টাইনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চরম ব্যর্থতা ও গাফিলতি। এ পর্যবেক্ষণ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশের গাফিলতি, ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা ও মৃত্যের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। রোগী পরীক্ষার জন্য শুধু একটি কেন্দ্রে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী পরীক্ষা করে যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তা অসম্পূর্ণ; নির্ভরশীল নয়। যে বিশাল জনগোষ্ঠী এ পরীক্ষার বাইরে তাদের মধ্যে কতজন সংক্রমিত রোগী আছে আর কতজন মারা যাচ্ছে সে হিসাব কেউ দিতে পারবে না। আরও দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে, বিদেশফেরত ব্যক্তি ছাড়াও বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই এ ধরনের ব্যক্তিরা ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছে। ২২ মার্চ, ২০২০ তারিখে সরকারের দেওয়া হিসাব মোতাবেক যে ২৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন তার মধ্যে ১০ জন বিদেশফেরত, বাকি ১৩ জন বিদেশফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। অবশিষ্ট চারজন সম্পর্কে তখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অতএব, বিধ্বংসী করোনাভাইরাস যে সমাজে Community) ছড়িয়ে পড়েছে তা পরিষ্কার। ২৬ মার্চ, ২০২০ তারিখের সর্বশেষ আইইডিসিআর অর্থাৎ সরকারি তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে সর্বমোট ৩৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন মোট পাঁচজন, আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন সাতজন। যদিও সরকারি এ তথ্য সম্পর্কে বিভিন্ন মহলে সন্দেহ রয়েছে যেহেতু বাংলাদেশে আইইডিসিআর ছাড়া করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার দ্বিতীয় কোনো স্থান নেই।
চীন, হংকং, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণকে মোটামুটি সামলে দিতে পেরেছে অবরুদ্ধ (Lockdown) করা এবং দ্রুত পরীক্ষা পরিচালনার মাধ্যমে। বর্তমানে আক্রান্ত পশ্চিমা দেশগুলো একই পথে হাঁটছে। ২৪ মার্চ, ২০২০ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতের ১৩৮ কোটি মানুষের দেশ ২১ দিনের জন্য বন্ধ (Lockdown) ঘোষণা করেছেন। বর্তমানে ইতালিতে করোনাভাইরাসের তান্ডব চলছে। বিশেষজ্ঞরা করোনা সম্পর্কে ইতালির দীর্ঘ নীরবতা, উদাসীনতা ও অবজ্ঞা করাকে দায়ী করেছেন। ইতালিসহ বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের পিছে নয়, সামনে ছুটতে হবে। যারা এ উপলব্ধিতে পিছে পড়েছে তারাই তার খেসারত দিচ্ছে।
বাংলাদেশে অপ্রতুল টেস্ট (পরীক্ষা) ব্যবস্থার মধ্যেও যারা রোগী হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন বা ভবিষ্যতে হবেন তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল এখনো প্রস্তুত হয়নি। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (Personal Protection Equipment-PPE) পর্যাপ্ত আমদানি করা হয়নি। বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসার সময় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর সংক্রমিত হওয়ায় অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। চীনের উহান শহরে প্রথম যে চিকিৎসক করোনাভাইরাস শনাক্ত করেছিলেন, তিনি আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াও ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় নিবিড় পরিচর্র্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও ভেনটিলেশন মেশিন অপ্রতুল। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় এসব সুবিধা নেই, সুবিধা সৃষ্টির কোনো পদক্ষেপও নেই।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বসহ বাংলাদেশ যখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং তার মোকাবিলায় সারা জাতি যখন যুদ্ধে লিপ্ত, তখন বাংলাদেশে আরেকটি মরণব্যাধি ‘ডেঙ্গু’ দরজায় কড়া নাড়ছে। সাধারণত মে-জুনে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার জন্মের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যেসব এলাকায় ডেঙ্গুবাহক এডিস মশা একবার বিস্তার লাভ করে, সে এলাকায় পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এডিস মশার ডিম শুকনো পরিবেশে নয় মাস পর্যন্ত নষ্ট হয় না। যখনই বৃষ্টির পানির সংস্পর্শে যাবে, তখন তা লারভায় পরিণত হয় এবং পরিপূর্ণ মশার জন্ম হয়। উদ্বেগের বিষয় এই যে, গত বছর সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুজ¦র নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ এবং মৃত্যুবরণ করেছিল ২৪৮ জন। পত্র-পত্রিকার তথ্যানুযায়ী প্রকৃত ভর্তির ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক। ১৯৯৬ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হওয়ার পর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের ও মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ। গত বছরে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে সারা দেশে। এ অবস্থায় গত বছরের ডেঙ্গু প্রকোপের ভয়াবহতা (মহামারী) থেকেই এ বছরের সতর্কবার্তা বিদ্যমান। গত বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতার কারণে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করেছিল। ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে হলে এডিস মশাকে নিধন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই মার্চ-এপ্রিলেই (বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে) দুই সিটি করপোরেশন এবং সারা দেশে পৌরসভাসমূহে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও কার্যকর ওষুধ ছিটিয়ে এডিস মশার ডিম ধ্বংস করার এখনই সময়। তা না হলে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
গত বছরে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নির্মূলে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার কারণ এবং দায়ীদের চিহ্নিত করার জন্য বিগত ২২ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ ঢাকা জেলা জজের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কমিটিকে ভবিষ্যতে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে সুপারিশমালা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। এ কমিটিকে ১৫ জানুয়ারি, ২০২০ তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত তারিখে প্রতিবেদন দাখিলে ব্যর্থ হলে তাদের আরও দুই মাস সময় বৃদ্ধি করা হয়। অর্থাৎ ১৫ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন পেলেও তাদের সুপারিশ মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের আর সময় অবশিষ্ট থাকবে না। ইতিমধ্যে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৪১ জন। গত বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল মাত্র ৫৬ জন। বিগত বছরের তুলনায় এ বছরে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে চার গুণের বেশি। অর্থাৎ এ বছর ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ গত বছরের চেয়ে আরও ভয়াবহ হতে পারে। এ অবস্থায় ডেঙ্গু প্রকোপের এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে এখনই সারা দেশে এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে।
উদ্ভূত এ কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সব মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিলম্বে হলেও সরকারকে তাদের দম্ভ, অহংকার ও প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করা জরুরি। জাতীয় দুর্যোগ বিবেচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জনগণকে আস্থায় নিয়ে করোনাভাইরাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানানো উচিত। অন্যান্য দেশের মতো এই অদৃশ্য শক্তির মোকাবিলায় সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। সারা দেশে সর্বাত্মকভাবে ভাইরাস পরীক্ষা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা ও উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রস্তুত করাসহ সব কার্যক্রম সমন্বিতভাবে জোরদার করতে হবে। ডেঙ্গুর সম্ভাব্য ভয়াবহ প্রকোপ থেকে দেশের জনগণকে রক্ষা করতে একই সঙ্গে এখনই এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস ও ডেঙ্গু রোগ চিহ্নিত করার পর্যাপ্ত পরীক্ষার কিট আমদানি করা অত্যাবশ্যক। ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পৃথক ইউনিট প্রস্তুত করার আগাম কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিধ্বংসী করোনাভাইরাস ও সম্ভাব্য ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে জনগণকে সুরক্ষা করা সহজ হবে না। আগাম প্রস্তুতি ও দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফলতা লাভ করার কোনো বিকল্প নেই। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা আমাদের সহায় হবেন।
লেখক : সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সদস্য জাতীয় স্থায়ী কমিটি-বিএনপি।