হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় যেমন ছিলেন খালেদা জিয়া
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই ৭৭৮ দিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার জানান, বেলা ৩টা ৫ মিনিটের দিকে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে ব্যক্তিগত ও খুব জরুরি বিষয় ছাড়া কারো সাথেই কোনো কথা বলেননি তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেল থেকে মুক্তি দেয়ার পর পরিবারের সদস্যরা এবং বিএনপির মহাসচিব তাকে গ্রহণ করেন। এর ঘণ্টাখানেক পরে হাসপাতালের কেবিন থেকে হুইল চেয়ারে করে কঠোর নিরাপত্তায় তাকে বের করে গাড়িতে তোলা হয়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেও সে সময় বিএনপির শতশত নেতাকর্মী সেখানে ভিড় করে খালেদা জিয়ার নামে স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের সামলাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও নিরাপত্তাকর্মীরা হিমশিম খান। তবে সেখান থেকে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার ব্যক্তিগত গাড়িতে নিজে ড্রাইভ করে খালেদা জিয়াকে সরাসরি গুলশানের বাসভবনে নিয়ে যান। এ সময় তার ভাবি কানিজ ফাতেমা ও ভাগ্নে অভিক ইস্কান্দারও গাড়িতে ছিলেন। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় হাল্কা গোলাপি রঙয়ের শাড়িতে খালেদা জিয়াকে মাথা ঢেকে পুরোনো সেই চশমায় দেখা গেছে। তবে কারাগারে যাওয়ার আগের তুলনায় তিনি অনেক শুকিয়ে গেছেন। মুখে মাস্ক ছিল।
এরআগে সকাল থেকেই বিএসএমএমইউ প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকেন বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। যদিও করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিএনপির দফতর থেকে বিএসএমএমইউতে না আসতে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বিএনপি। তবুও বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী তাদের নেত্রীর মুক্তির খবর পেয়ে সেখানে সমবেত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। একপর্যায়ে বিকেল পৌনে ৩টার দিকে আসেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বেগম খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, ভাগ্নে অভিক ইস্কান্দারসহ পরিবারের অন্য কয়েকজন সদস্য এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীরা। পরে মির্জা ফখরুল, শামীম ইস্কান্দার, চিকিৎসকদের একটি প্রতিনিধি দল ও আরো কয়েকজন বিএসএমএমইউর প্রিজন সেলে খালেদা জিয়ার কেবিনে যান। চিকিৎসকদের মধ্যে ছিলেন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সভাপতি অধ্যাপক ডা: হারুন আল রশিদ, মহাসচিব ডা: আবদুস সালাম, বিএসএমএমইউর ড্যাব নেতা ডা: এরফানুল হক সিদ্দিক, ডা: শেখ ফরহাদ ও নার্স জাহানারা সিদ্দিকী।
খালেদার জিয়া বাসার উদ্দেশে রওয়ানা দিলে বিএসএমএমইউ থেকে বেরিয়ে কথা হয় ড্যাব সভাপতি অধ্যাপক ডা: হারুন আল রশিদের সাথে। তিনি বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন এটা নিঃসন্দেহে খুশির সংবাদ। কিন্তু তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হলে আমরা অনেক বেশি খুশি হতাম। তিনি বলেন, নেত্রী যখন বের হন তিনি কারো সাথে কোনো বিষয়ে কথা বলেননি। আমার ধারণা, সারা বিশ^ এমনকি বাংলাদেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি খুবই বিমর্ষ। মানসিকভাবে চিন্তিত। দীর্ঘ দিন কারাভোগের কারণে এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত দেশনেত্রীর স্বাস্থ্য শুকিয়ে গেছে। তার দ্রুত উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। এটা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে। এ জন্য শর্ত তুলে নিয়ে তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান ডা: হারুন আল রশিদ। জাহানারা সিদ্দিকী বলেন, বেগম খালেদা জিয়া কারো সাথেই কোনো কথা বলেননি। আমরাও কোনো কথা বলিনি। তাকে একটু বিমর্ষ লাগছিল।
এ দিকে খালেদা জিয়ার মুক্তির খবরে নেতাকর্মীরা বাঁধভাঙা উল্লাস করেছেন। বের হওয়ার পরপরই হাসপাতালের ভেতরেই তার গাড়িকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের প্রচণ্ড ভিড় জমে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে নির্দেশনা, সে কথা কারো মাথায়ই ছিল না। খালেদা জিয়া বিএসএমএমইউ থেকে বের হওয়ার পর গাড়ির সাথে সাথে নেতাকর্মীদের কেউ কেউ মোটরসাইকেলে এবং তাদের একটি বড় অংশ হেঁটে এগোতে থাকে। কারো কারো হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। নেতাকর্মীদের ভিড়ের কারণে খালেদা জিয়াকে বহনকারী গাড়ি ধীরগতিতে এগোচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে একপর্যায়ে পুলিশ বিএনপির নেতাকর্মীদের লাঠিপেটা শুরু করে। বিকেল ৪টা ২০ মিনিটের দিকে গুলশানের বাসার উদ্দেশে বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়ি বহর রওয়ানা হয়। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর ঘিরে উল্লাস করতে থাকেন নেতাকর্মীরা। তারা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তোলেন গোটা এলাকা।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন হাতে নিয়ে শাহবাগ ও গুলশানে অবস্থান নেন। কর্মীদের উজ্জীবিত করতে স্লোগান ধরেন অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। বিএসএমএমইউ থেকে বের হওয়ার পরপরই সেখানে অবস্থানরত নেতাকর্মীরা ‘এই মুহূর্তে খবর এলো, খালেদা জিয়া মুক্তি পেল’ বিভিন্ন স্লোগান ধরেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন, চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার, শায়রুল কবির খান, ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি নাজমুল হাসান, সাবেক সহসাংগঠনিক সম্পাদক কাজী ইফতেখায়েরুজ্জামান শিমুল, স্বেচ্ছাসেবক দলের হারুন অর রশিদ, মোর্শেদ আলম, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক তানজিল হাসান, ঢাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো: রাকিবুল ইসলাম, সদস্য সচিব আমান উল্লাহ আমান ও সদস্য তরিকুল ইসলাম সহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের হাজারো নেতাকর্মী।