ফের উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কেন ঘনিষ্ঠ হতে চায় ভারত
বিশ্ব যখন মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর ভূমিকার দিকে মনোযোগী, তখন ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির আওতায় পূর্ব এশিয়ার দিকে নজর দিয়েছে এবং এই অঞ্চলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি, কোরীয় উপদ্বীপে—বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ায়—ভারতের প্রভাব বিস্তারের নীতির বাস্তবায়নে নয়াদিল্লি নীরবে সতর্কভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, উত্তর কোরিয়া অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে কাজ করার নীতি অনুসরণ করার কারণে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি আলোচনা বা অন্যান্য উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে নয়াদিল্লিকে গোপনে কাজ করতে বাধ্য করেছে।
এর আগে, ২০২১ সালের জুলাইয়ে ভারত নীরবে পিয়ংইয়ংয়ে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয় এবং রাষ্ট্রদূত অতুল মালহারী গৎসুরভে দূতাবাসের সব কর্মীকে মস্কোর সহায়তায় নয়াদিল্লিতে ফিরে আসেন। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো দূতাবাসটি ‘বন্ধ’ ঘোষণা করেনি, তবে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় তারা জানিয়েছিল, কোভিড-১৯ এর কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
এরপর কয়েক বছর কেটে গেলেও পিয়ংইয়ংয়ে ভারতীয় কূটনৈতিক মিশন নিয়ে কোনো আপডেট আসেনি। এক বছরের বেশি সময় আগে গৎসুরভেকে মঙ্গোলিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে চলতি মাসের শুরুর দিকে হঠাৎ করেই ভারত পিয়ংইংয়ে দূতাবাস আবারও সচল করার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েক দিনের মধ্যেই কারিগরি এবং কূটনৈতিক কর্মীদের একটি দল উত্তর কোরিয়ার উদ্দেশে পাঠানো হয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের কারিগরি দলটি এরই মধ্যে পিয়ংইয়ংয়ে পৌঁছে দূতাবাসকে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তবে প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বন্ধ থাকা দূতাবাসে প্রথমে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিদর্শন চালাতে হবে। উত্তর কোরিয়ার সন্দেহজনক গোয়েন্দা কার্যকলাপের প্রমাণ আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য জন্য দূতাবাস ভবনটিকে আগে সম্পূর্ণভাবে ‘ডিবাগ’ বা পরিষ্কার করতে হবে। এ ছাড়া, উত্তর কোরিয়ার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে নতুন রাষ্ট্রদূত ও বাকিদের সেখানে যোগ দিতে আরও কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার কৌশলগত গুরুত্ব চার বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি—শুধু ভারতের জন্যই নয়, পুরো এশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের জন্যও। সামরিকভাবে, উত্তর কোরিয়া ধীরে ধীরে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার বাড়িয়ে চলেছে এবং পাশাপাশি হাইপারসনিক মিসাইল, ট্যাকটিক্যাল অস্ত্র, স্বল্প, মধ্যম এবং দূরপাল্লার মিসাইলসহ নানা প্রযুক্তি দ্রুত উন্নয়ন করছে। ভারতের জন্য, পিয়ংইয়ংয়ে উপস্থিত থাকা এবং এমন একটি সম্পর্ক তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এই প্রযুক্তি পাকিস্তান বা কোনো দুর্বৃত্ত উপাদানের হাতে না পৌঁছায়।
গত কয়েক বছরে উত্তর কোরিয়া রাশিয়া, চীন এবং ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গভীর করেছে—এশিয়ায় একটি বাড়তে থাকা জোট, যেটিকে অনেকেই কোয়াডের পাল্টা হিসেবে দেখছেন। কোয়াড হলো একটি নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক জোট, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া রয়েছে। এটি ভারতের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক অগ্রাধিকার।
নয়াদিল্লির রাশিয়ার সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং তেহরানের সঙ্গেও তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো। প্রতিবেশী ভারত ও চীন—বিশ্বের দুটি জনবহুল দেশ—এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মতপার্থক্য দূর করতে কাজ করছে। বাকি থাকছে পিয়ংইয়ং—যার সঙ্গে নয়াদিল্লি এ পর্যন্ত অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
এদিকে, উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কও বাড়িয়েছে এবং ইউক্রেনে রুশ সেনাদের পাশে যুদ্ধ করতে নিজ সৈন্য পাঠিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার বাড়তে থাকা গুরুত্ব এবং এশিয়াজুড়ে তাদের সক্রিয়তার বিষয়টি মাথায় রেখে, নয়াদিল্লি তাদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্য অনুযায়ী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। সে কারণেই পিয়ংইয়ংয়ে দূতাবাস পুনরায় চালু করা এই যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।