ভারতে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড়

0

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় সরকারি হাসপাতালের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে এক নারী চিকিৎসকের। এই ঘটনায় ধর্ষণ ও হত্যার মামলা রুজু করেছে পুলিশ।

গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে। এই ঘটনার বিরুদ্ধে উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে।

শুক্রবার সকালে সহযোগী এক চিকিৎসক দেখেন, অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে চিকিৎসকের মরদেহ।

মৃত ওই চিকিৎসক স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। কর্তব্যরত ট্রেনি চিকিৎসকরা প্রতি রাতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সেমিনার রুমে বিশ্রাম নেন। বৃহস্পতিবার রাতে ফুড ডেলিভারি সংস্থার কাছ থেকে খাবার আনান চেস্ট মেডিসিন বিভাগের ওই চিকিৎসক।

সহযোগী অন্যান্য চিকিৎসকদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খান তিনি।

সেদিন মধ্যরাতে অলিম্পিকে জ্যাভলিন থ্রোর ফাইনালে নেমেছিলেন ভারতের নীরজ চোপড়া। সেই খেলা চিকিৎসকরা সকলে মিলে দেখেন। রাত প্রায় দেড়টা নাগাদ ইভেন্ট শেষ হয়। এরপর রাত দুইটার দিকে ঘুমোতে যান ৩১ বছর বয়সী ওই নারী চিকিৎসক।

পরের দিন সকালে সহযোগী এক চিকিৎসক দেখতে পান, সেমিনার রুমে পড়ে রয়েছে চিকিৎসকের মরদেহ। শরীরের নিম্নাঙ্গে কোনো কাপড় নেই। শরীরের ওপরের অংশের পোশাকও ছেঁড়া। পাশে পড়ে রয়েছে তার ভাঙা চশমা।

শুক্রবার হাসপাতালেই নিহতের ময়নাতদন্ত হয়। যৌনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মুখ ও শরীরের অন্যত্র আঘাত ও নখের আঁচড়ের চিহ্নও ছিল। শ্বাসরোধ করে হত্যার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে।

ময়নাতদন্তের সময় ছিলেন স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরাও। অন্য হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞদেরও আনা হয়েছিল। ময়নাতদন্তেই অনুমান করা হয়, ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে ওই নারী চিকিৎসককে।

সিভিক ভলান্টিয়ার আটক

নারী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কলকাতা পুলিশের এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ওই ব্যক্তির নাম সঞ্জয় রায়। আরজি কর হাসপাতালে তার অবাধ যাতায়াত ছিল।

হাসপাতালের সেমিনার রুমে কোনও সিসিটিভি নেই। তার বাইরের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা। ফুটেজে চারজনের ছবি দেখা গেছে। এদের মধ্যে একজন সঞ্জয়। বাকি তিনজন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পরিবারের আত্মীয়। গভীর রাতে তলব পেয়ে তারা চেস্ট মেডিসিন বিভাগে এসেছিলেন।

জিজ্ঞাসাবাদে সঞ্জয়ের বক্তব্যে অসঙ্গতি ছিল। সে সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেনি। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শনিবার গ্রেপ্তারকৃতকে শিয়ালদহ আদালতে পেশ করা হয়। বিচারক আবেদন অনুযায়ী অভিযুক্তকে ১৪ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে।

ধরিয়ে দিল হেডফোন

সূত্রের খবর অনুযায়ী, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ভোর চারটার দিকে সেমিনার রুমে ঢুকছে সঞ্জয়। বেরিয়ে আসছে সাড়ে চারটার দিকে। মৃতদেহের পাশে পড়েছিল একটি হেডফোন। সেমিনার রুমে প্রবেশের সময় সঞ্জয়ের গলায় ব্লুটুথ হেডফোন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বেরোনোর সময় সেটি ছিল না।

মরদেহের পাশে উদ্ধার হওয়া হেডফোন সঞ্জয়ের, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সঞ্জয় সিভিক ভলান্টিয়ার হলেও হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে সে যথেষ্ট দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করত বলে সূত্রের খবর। রোগী ভর্তির ক্ষেত্রেও তার হাত থাকত।

এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ভেতরের কেউ এই ঘটনা ঘটিয়েছে। যাকে ধরা হয়েছে, সে ওখানে যাতায়াত করত। সে যেই হোক, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলা নিয়ে গিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে।’

প্রতিবাদের ঝড়

এদিকে নারী চিকিৎসকের মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই উত্তপ্ত আরজি কর হাসপাতাল। প্রতিবাদে পথে নেমেছেন ছাত্ররা। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে জুনিয়র চিকিৎসকদের একাংশও কর্মবিরতি পালন করেছেন। এর ফলে ব্যাহত হয়েছে চিকিৎসা পরিষেবা।

শুক্রবার ময়নাতদন্তের পর মরদেহ নিয়ে বের হওয়ার সময় বাধা দেন বিজেপি ও বাম কর্মীরা। তাদের অভিযোগ, পুলিশ ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ একেবারে শুরুতে এটিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করেছিল। যদিও ময়নাতদন্তের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। সেই কারণে ছাত্রদের একাংশ এই ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, সিবিআই তদন্তে তাদের কোনো আপত্তি নেই।

শনিবার একের পর এক মিছিলে স্তব্ধ হয়েছে কলকাতার পথঘাট। এসএফআই, ডিএসও মিছিল করেছে। পথে নেমেছেন কলেজের নারী চিকিৎসক, সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সদস্যরা।

মৌলালি, শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে একের পর এক মিছিল এসেছে আরজি কর হাসপাতালে। মূল ফটকের সামনে পুলিশের ব্যারিকেড ও হাসপাতালের শিক্ষার্থীদের অবরোধে মুখে আটকে যায় কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একটি মিছিল। তুমুল ধস্তাধস্তিতে উত্তেজনা চরমে পৌঁছয়।

পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভকারীদের। একাধিক আন্দোলনকারীকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে দেয় পুলিশ। এক বিক্ষোভকারীকে কিল, ঘুষি মারতে দেখা যায়। এক বাম নারী কর্মীকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।

আরজি করের ছাত্রদের বক্তব্য, রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের পতাকা নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢোকা যাবে না। বামেদের দাবি, শাসক দলের সমর্থক ছাত্র ও পুলিশ তাদের বাধা দিয়েছে।

একটা হত্যাকাণ্ডের জেরে আন্দোলন ঘিরে এই টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। আরজি কর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিরাপত্তার খোলনলচে বদলে ফেলা হবে।

আরজি কর হাসপাতালে নার্সিংয়ের ছাত্রী বর্ণিকা বিশ্বাস বলেন, ‘একজন বাইরের লোক ভেতরে ঢুকে এই কাণ্ড ঘটাবে, ভাবা যায় না। আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? কবে আমাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হবে? আমরা বেশ কয়েকটি দাবি জানিয়েছি, যাতে ভবিষ্যতে এই ঘটনা না ঘটে।’

সিসিটিভি ফুটেজ থেকে কী কী পেয়েছে পুলিশ?

সেমিনার হলে সিসি ক্যামেরা না থাকলেও ঘটনাস্থল এবং হাসপাতালের আশপাশের ক্যামেরার ফুটেজ খতিয়ে দেখেছে পুলিশ। সেই ফুটেজ দেখেই অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তকে ঘটনার রাতে দুবার সেমিনার হলের বিল্ডিংয়ে ঢুকতে দেখা যায়।

প্রথমবার বৃহস্পতিবার রাত ১১টা দিকে আরজি করে আসেন অভিযুক্ত যুবক। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসেন। তারপর ৪টার আবারও সেই বিল্ডিংয়ে যান এবং ৩০-৩৫ মিনিট পর বেরিয়ে বাড়ি চলে যান। তদন্তকারীদের অনুমান, ওই সময়ের মধ্যেই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।

অভিযোগ স্বীকার করলেও অনুতপ্ত নন অভিযুক্ত ব্যক্তি

আরজি কর হাসপাতালে ঢুকে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন অভিযুক্ত। এমনটাই জানা গেছে তদন্তকারীদের সূত্রে। তবে অপরাধের কথা স্বীকার করলেও এখনও তার মধ্যে কোনও অপরাধবোধ দেখা যাচ্ছে না বলেই তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গেছে।

তদন্তকারীদের একটি অংশের দাবি, কোনও অনুতাপবোধ নেই অভিযুক্তের মধ্যে। বরং অভিযুক্ত জেরার সময় বলেছেন, ‘ফাঁসি দিলে দিন।’

কী বলছেন অভিযুক্তের মা?

ছেলে এমন কাজ করেছে, তা বিশ্বাসই করতে পারছেন না আরজি করের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের মা। অভিযুক্তের মায়ের কথায়, ‘ছেলে এই ঘটনা ঘটাতে পারে না।’

তবে ছেলের একাধিক বিবাহের কথা তার কানে এসেছিল বলে জানিয়েছেন বৃদ্ধা। একইসঙ্গে তাকে বিলাপের সুরে বলতে শোনা গেছে, ‘ছেলেকে জন্ম দিয়েই বিপদে পড়েছি’। তিনি আরও জানান, ছেলের সঙ্গে তার তেমন যোগাযোগ নেই। কবে শেষবার ছেলেকে বাড়িতে দেখেছেন তা-ও মনে করতে পারেননি বৃদ্ধা।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com