মাদকের ‘হটস্পট’ মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প,
মাদকের ‘হটস্পট’ হিসেবে পরিচিত রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প। বছরের পর বছর এখানে প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালালেও পরিস্থিতি তেমন বদলায় না। দিন দিন পরিস্থিতির অনেক অবনতি হয়েছে। এখন রীতিমতো লাইন ধরে মাদক কেনে আসক্তরা। রমরমা এই কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধও চরমে। সক্রিয় অন্তত ৯টি মাদক কারবারি চক্রের মধ্যে দুটি বারবার সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। তাদের মদদ দিচ্ছে আরও দুটি চক্র। এরই মধ্যে তাদের সংঘর্ষে এক শিশুর প্রাণ গেছে; আহত হয়েছে অন্তত ৩০ জন।
রমরমা মাদক কারবার ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্যাম্পের নন-লোকাল রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান এস কে গোলাম জিলানীর ভূমিকা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। মাসিক মোটা অঙ্কের চাঁদার বিনিময়ে তিনি কারবারিদের বিচরণের সুযোগ করে দেন। তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন আইনে একাধিক মামলাও রয়েছে। তাঁর ছেলেসহ পরিবারের কয়েক সদস্যও এই অপকর্মে জড়িত।
তবে এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে জিলানী বলেন, ‘আমি মাদক কারবার বন্ধের জন্য থানার ওসি থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে চিঠি দিয়েছি। এসব কারণে মাদক কারবারিরা আমাকে পছন্দ করে না। তারা এবং আমার বিপক্ষের কিছু লোক আমার নামে অপপ্রচার চালায়। আমি বা পরিবারের কেউ মাদকের সঙ্গে যুক্ত নই।’
তাঁর বিরুদ্ধে মাদক মামলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিচারকাজ চলছে। এখন এ নিয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না। আর আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো সঠিক হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’ জেনেভা ক্যাম্পের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মোহাম্মদপুর থানার ওসি মাহফুজুল হক বলেন, আধিপত্যের বিরোধে সেখানে মাঝমধ্যে ঝামেলা হচ্ছে। নিয়মিত অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ ও শিশুমৃত্যুর ঘটনায় করা দুই মামলায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দুই চক্রের সংঘর্ষে ক্যাম্পে অস্থিরতা
গত ২ রমজান মাদক কারবারি দুটি চক্র ক্যাম্পে সংঘর্ষে জড়ায়। চক্র দুটির নেতা হলেন মো. সোহেল ওরফে ভূঁইয়া সোহেল এবং মো. মনু ওরফে গালকাটা মনু। পরে স্থানীয় কয়েকজনের সমঝোতায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু আবার তাদের মধ্যে ছোটখাটো মারামারি হয়। এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে ঈদের পর। এ পর্যন্ত ১০-১২ বার তারা সংঘর্ষে জড়িয়েছে। সোহেলকে সমর্থন দিচ্ছে সৈয়দপুরিয়া বাবু ওরফে আমজাদ আর মনুকে সমর্থন দিয়েছে চুয়া সেলিম। তাদের সমমনা চক্রগুলোও প্রচ্ছন্নভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। এ কারণে দুই চক্রের বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে।
এক বাসিন্দা জানান, মনুর সহযোগী ইমতিয়াজের চাচা মোক্তার এক সময় সোহেলের মাদক বিক্রি করত। লেনদেন নিয়ে ঝামেলায় সে সরে আসে। এই বিরোধে জড়ায় ইমতিয়াজ, তার বাবা ছোটুসহ কয়েকজন। সেখান থেকেই মনু চক্রের সঙ্গে সোহেলের বিরোধের সূত্রপাত। ক্রমেই তা বাড়তে থাকে। এখন ক্যাম্পের কত স্পট কার দখলে থাকবে, তা নিয়ে তীব্র বিরোধ চলছে।
সক্রিয় ৯টি চক্র
জেনেভা ক্যাম্পে সোহেল, মনু, সৈয়দপুরিয়া বাবু, সেলিম ছাড়াও অন্তত পাঁচজনের চক্র সক্রিয়। সেগুলোর দলনেতা– টিপু তাহেরী, পিচ্চি রাজা, মো. মাহমুদ ওরফে পটল মাহমুদ, মো. আলমগীর ওরফে আন্ডা আলমগীর ও লেংড়া আলমগীর। তাদের মধ্যে সৈয়দপুরিয়া বাবু চক্রের নেপথ্যে রয়েছে জাহিদ মোল্লা। চক্রের কেউ গ্রেপ্তার হলে তাকে ছাড়িয়ে আনাসহ প্রশাসনিক দেনদরবার করে সে। একইভাবে সোহেল চক্রের আশ্রয়দাতা ক্যাম্পের চেয়ারম্যানের ছেলে এস কে রব্বানী। টিপু তাহেরী ক্যাম্পে ইয়াবার কারবার চালু করে। সে নিজে ক্যাম্পে না থাকলেও পুরো কারবার এখনও তার নিয়ন্ত্রণে। এক সময়ের কুখ্যাত মাদক কারবারি পাঁচু ও তার স্ত্রী পাপিয়া তার কারবারের প্রধান ছিল। এখন রাজিয়াসহ অন্যরা চালাচ্ছে। আরেক কুখ্যাত মাদক কারবারি ইশতিয়াক চক্রের ছয় সদস্যের একজন চুয়া সেলিম। ইশতিয়াক ভারতে মারা যাওয়ার পর সে এখন চক্রের প্রধান। মাহমুদ ইয়াবার ‘হোম ডেলিভারি’র জন্য মাদকসেবীদের কাছে সুপরিচিত। সে ক্যাম্প চেয়ারম্যানের ভাতিজা। আন্ডা আলমগীর নিজেই চোলাই মদ তৈরি ও বিক্রি করে।
লাইন ধরে মাদক ক্রয়
হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে, সুলভ মূল্যে নিত্যপণ্য কেনার জন্য সবাই লাইনে দাঁড়িয়েছে। আসল ঘটনা হলো, তারা মাদক কেনার অপেক্ষায়। এটি জেনেভা ক্যাম্পের নিত্যদিনের চিত্র। সোহেল চক্রের ক্যাশিয়ার আরিফ কসাই লাইনগুলো তদারক করে। ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের আল-ফালাহ মেডিকেল গলি, একই এলাকার মাঝের গলি এবং পাবলিক টয়লেট ও গোসলখানার সামনে দেখা যায় এসব লাইন।
-সমকাল