চাঁদা-টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ নানান অপকর্মে টালমাটাল ছাত্রলীগ

0

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগে টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তৃণমূলের কিছু নেতাকর্মী জড়িয়ে পড়েছেন নানা অপকর্মে। এর মধ্যে ক্যাম্পাস ও হল দখল, সিট ও কমিটি বাণ্যিজ্য, চাঁদা ও টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষার্থী নির্যাতন-হয়রানির মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নানা বিষয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় ও অর্ধশতাধিক ইউনিট কমিটি, নড়বড়ে সাংগঠনিক কাঠামোর কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-তৃণমূল সংগঠনের কমিটি গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করেছে। ফলে ছাত্রদের নিয়ে ইতিবাচক কর্মসূচির পরিবর্তে দেশজুড়ে বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছেন একশ্রেণির নেতাকর্মী। এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে নামমাত্র ব্যবস্থা নিচ্ছে ছাত্রলীগ। অনেক সময় সাময়িক বহিষ্কারের মতো লঘু শাস্তি দিয়ে পরবর্তীকালে আবার স্বপদে বহাল করা হচ্ছে অপরাধীদের। এতে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠছেন নেতাকর্মীরা। আর তাদের এমন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়ছে মূল দলের ভাবমূর্তিতেও।

ছাত্রলীগের বর্তমান নেতিবাচক কার্যক্রমে মনে হচ্ছে তাদের ‘কাঁধে ভূত চেপেছে’। কারণ তাদের অপকর্মে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য যে প্রশসংসা হচ্ছে, সেখানে কিছুটা হলেও ম্লান হবে-এমন অভিমত সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, এর প্রভাব পড়বে ভোটের রাজনীতিতেও। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সমস্যার মূলে যেতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল হওয়ায় ছাত্রলীগের ইউনিটগুলোতে নেতৃত্বের জট তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে তৃণমূলেও সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। নিয়মিত নতুন কমিটি না হওয়ায় অছাত্ররা নেতা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। সংগঠনের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে গ্রুপিং, কোন্দল। বয়স্করা ছাত্রনেতা হওয়ায় এবং চাকরির বয়স না থাকায় তাদের মধ্যে অবৈধভাবে অর্থ আয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোকে তারা টাকা আয়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছেন। এ ক্ষেত্রে ক্যাম্পাস ও বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। সর্বশেষ রোববার রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে পল্টন থানা ও রমনা থানা ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তবে বেশির ভাগ ঘটনাতেই দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যেকোনো মূল্যে ছাত্রলীগের লাগাম টানা জরুরি।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘যতদিন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগকে আওয়ামী লীগ নিজেদের সংগঠন বলে দাবি করবে, ততদিন তাদের সব কার্যক্রমের দায় আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। কাগজ-কলমে যাই থাকুক না কেন, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন এটা সবাই জানি। কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে এটাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের সাফল্য ও ব্যর্থতা উভয়ের দায়ই দলটিকে নিতে হবে। এখানে ঝাড়া দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই। দেশজুড়ে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এগুলোর জন্য দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর যাতে এগুলোর পুনরাবৃত্তি না হয় তার নিশ্চয়তা এই দলকেই দিতে হবে। আর না হলে বলতে হবে, তারা আমাদের কেউই না, পুলিশ যেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প আমি দেখি না।’ তিনি আরও বলেন, এটা তো সরকারের জন্যও অস্বস্তিদায়ক বিষয় হওয়ার কথা। কারণ সরকারের যে উন্নয়নের কথা আমরা শুনছি বা দেখছি, সেগুলো ম্লান করে দিতে পারে এ ধরনের কার্যক্রম। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী তো সবসময় এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেন। ছাত্রলীগ ছাত্রদের হাতে কলম তুলে দিয়েছেন, অস্ত্র তুলে দেননি- এটা তিনি বলেন। কিন্তু তারাতো (ছাত্রলীগ) এই কথার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। এগুলো প্রধানমন্ত্রীরও বিবেচনার বিষয়।’

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গত মাসে সারা দেশে ছোট-বড় অন্তত ৪৩টি অঘটন ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। এর মধ্যে সবচেয়ে নিন্দনীয় ঘটনা ঘটে রাজধানীর ইডেন কলেজে। সম্প্রতি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় হলে থাকা চার ছাত্রীকে চরম গালাগাল করেন এবং হুমকি দেন। এই ঘটনার একটি অডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে এর জন্য ক্ষমা চান। কিন্তু তার পুষে রাখা ক্ষোভের কারণে ঘটনার কয়েক দিন পর ওই চার ছাত্রীর দুজন ফের রিভার রোষানলে পড়েন। তাদের বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগ সভাপতির বিরুদ্ধে। দেশজুড়ে সমালোচিত হয় এই ঘটনা। তবুও রিভা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে এই ঘটনা ছাড়া সিট বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

রাজধানীর ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির কর্মকাণ্ড সামগ্রিক অপকর্মের একটি উদাহরণ মাত্র। অধিকাংশ ইউনিটেই এমন অরাজক অবস্থা বিরাজ করছে। শোকের মাস আগস্টে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি অঘটন ঘটিয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি ঘটনা ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে মাদকের আড্ডায় মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ। অন্য তিনটি শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা। রাবিতে গত ৬ আগস্ট নির্মাণাধীন ভবনে চাঁদা দাবি, ১১ আগস্ট শহিদ হবিবুর হলের দোকানের ক্যাশ থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনতাই, ১৭ আগস্ট নিজ দলের কর্মীকে মারধর করে টাকা ছিনতাই, ১৮ আগস্ট হলের দোকানে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা, ১৯ আগস্ট মতিহার হলের আবাসিক ছাত্রকে বেধড়ক পিটিয়ে ও গলায় ছুরি ধরে ২০ হাজার টাকা নেওয়ার ঘটনা ঘটান একশ্রেণির নেতাকর্মী। সর্বশেষ একাডেমিক ভবনের সামনে থেকে এক শিক্ষার্থীকে তুলে হলের কক্ষে নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করে ৪৫ হাজার টাকা চাঁদা নেয় রাবি ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় আল আমিন নামের ওই শিক্ষার্থী প্রাণনাশের ভয়ে বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়েই ক্যাম্পাস ছাড়েন। ছাত্রলীগের ভয়ে ক্যাম্পাসে আসতে না পেরে ২৬ আগস্ট কুরিয়ারযোগে লিখিত অভিযোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। এর বাইরে ২৭ আগস্ট রাতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) র‌্যাগিংয়ের ঘটনা সমাধান করতে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা অপদস্থ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. মো. রিজওয়ানুল হক (কনক)। চট্টগ্রাম কলেজে কয়েক বছরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ শতাধিক সংঘর্ষে জড়িয়েছে।

জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নামে যেসব কথা আসে তা প্রধানত দুটো কারণে হয়। একটি রাজনৈতিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং অন্যটি ক্ষমতার দাপট থেকে। রাজনৈতিক ক্ষোভের ঘটনাগুলোর পেছনে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট থাকায় তা রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। তবে ক্ষমতার দাপট থেকে যেই ঘটনাগুলো ঘটে সেগুলো সহজেই সমাধান করা যায়। এক্ষেত্রে ক্যাম্পাসগুলোতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হয়ে কাজ করতে হবে। কারণ ছাত্র যেই মত বা পথেরই হোক না কেন, অন্য ছাত্র বা কোনো ব্যক্তি তার গায়ে হাত দিতে পারে না। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ছাত্রলীগের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বন্ধে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এমন একটি দল যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো সংগঠনের নেতাদেরও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসাবে ছাত্রলীগের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের দায়-দায়িত্ব আছে। ছাত্রলীগের কেউ যদি শিক্ষাঙ্গন বা এলাকার পরিবেশ বিনষ্ট করে সেটা দেখার দায়িত্বও তাদের রয়েছে। শিবিরের কেউ ছদ্মবেশে ঢুকে কিছু করছে কিনা সেই বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।

ছাত্রলীগের এ অবস্থার পেছনে সাংগঠনিক নড়বড়ে কাঠামোকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব ইউনিটে বেশি অপকর্মের ঘটনা ঘটছে, তার বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে। সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছর মেয়াদি কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে বহু আগেই। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের দুই বছরের কমিটি এখন নয় বছর পার করছে। এক কমিটিতেই নয় বছর পার করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। এক যুগ অতিবাহিত হলেও নতুন কমিটি করা হয়নি বরিশাল জেলায়। ২০১১ সালের ৯ জুলাই গঠিত কমিটি এখনো সেখানে বহাল।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ দুবছর আর ইউনিট কমিটির এক বছর। ২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়। এরপর ৩১ জুলাই রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। পরে ১০ মাসের জন্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে লেখক ভট্টাচার্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের ভারমুক্ত ঘোষণা দিয়ে নিয়মিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ সম্মেলন থেকে হিসাব করলে বর্তমান কমিটি চার বছর অতিবাহিত করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও পরবর্তী সম্মেলন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তুতি বা ঘোষণার কথা জানায়নি ছাত্রলীগ।

কেবল কেন্দ্রীয় কমিটি নয়, বর্তমানে সারা দেশে সংগঠনটির ১১৬টি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি রয়েছে অর্ধশতাধিক ইউনিটে। জয়-লেখক দায়িত্ব গ্রহণের পর মাত্র ৫২টি ইউনিটে নতুন কমিটি গঠন করে। এছাড়া ১৬টি মেডিকেল কলেজ নতুন কমিটি দিয়েছে তারা। ৫২টি ইউনিটের কমিটির মধ্যে ২০১৯ সালে মাত্র একটি, ২০২০ সালে পাঁচটি, ২০২১ সালে ১৮টি এবং চলতি বছরে ২৮টি কমিটি দেওয়া হয়। আবার এই বছরে যে কমিটিগুলো দেওয়া হয়েছে তার সাতটিই দেওয়া হয় শোকাবহ আগস্ট মাস শুরুর আগের দিন ৩১ জুলাই। এই দিনে ছাত্রলীগের বর্ধিত কমিটির নামে সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে কেন্দ্রীয় পদ প্রদানের চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর শোকের মাসজুড়ে ছাত্রলীগে বয়েছে ‘অভিনন্দন ঢেউ’। এদিকে ছাত্রলীগের যেসব ইউনিটে নতুন কমিটি হয়েছে তার বেশির ভাগ নিয়েই অর্থ লেনদেনসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। বরিশাল মহানগরে অছাত্র ও বিবাহিতদের নিয়ে গঠিত কমিটি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এখান প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এই কমিটির পর সেখানে দীর্ঘদিন বিক্ষোভও হয়েছে। বরগুনায় জেলা ছাত্রলীগের কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। কমিটি গঠনের পর চোখে পড়ার মতো বিক্ষোভ হয়েছে কক্সবাজার ও সিলেটেও। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি গঠনের পরেও তৈরি হয় নানা বিতর্ক।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের বিষয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতার একজন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ছাত্রলীগ বিশাল ছাত্র সংগঠন। এখানে সবাই ‘দুধে ধোয়া তুলসী পাতা’ তা আমরা বলছি না। এখানে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে। আর এমন হলে যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে অহেতুক ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করার একটা চেষ্টা থাকে। কারণ তারা জানে, ছাত্রলীগকে বিতর্কিত করতে পারলে আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করা যায়। পত্রিকায় ছাত্রলীগকে নিয়ে যেসব সংবাদ আসে তার ৮০ শতাংশই সঠিক নয়। ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রদের নিয়ে কমিটি গঠন এই সংগঠনের একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। আগামী সম্মেলন নিয়েও ছাত্রলীগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে সম্মেলনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে বলে জানতে পেরেছি।

ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, জয় ও লেখক দায়িত্ব গ্রহণের পর ১১২টি ইউনিটে দুই থেকে তিনজন করে কেন্দ্রীয় নেতাকে দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় নেতা মনোনীত না থাকা পাঁচ ইউনিটেও দায়িত্ব প্রদানের কাজ চলছে। সেগুলো হলো-বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা আইন জেলা। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতারই অভিযোগ, কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের অনেক পরে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সংসদের শূন্যপদ পূরণ করা হয়। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর কেন্দ্রীয় নেতাদের ইউনিটভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। ফলে ইউনিটগুলো তাদের কথা শুনতে চায় না। সে কারণে ইউনিটগুলোর বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ এলে তাদের তেমন কিছুই করার থাকে না।

আর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন না। এছাড়া জয়-লেখক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদকে নিয়ে একটি সাধারণ সভা কিংবা বর্ধিত সভাও করেনি। ফলে কোনো ফোরামেও তাদের কথা বলার সুযোগ থাকে না। এতে করে তৃণমূল সংগঠন যেভাবে খুশি সেভাবেই চলছে।

নেতাকর্মীরা বলছেন, নিয়মিত কমিটি হলে অনেক অপরাধই কমে যাবে। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা রাজনীতি করেন তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। যদি নিয়মিত কমিটি হয় সেক্ষেত্রে পদ না পেলে তারা পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার সুযোগ পান। কিন্তু অনিয়মিত কমিটি হলে পদ না পেলে একদিকে পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে ছাত্রলীগের বেঁধে দেওয়া ২৯ বছর বয়সের সময়সীমার কারণে পরবর্তী কমিটিতে রাজনীতি করারও আর সুযোগ থাকে না। হারিয়ে যায় সরকারি চাকরিতে যোগদানের বয়স। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাড়াই ছাত্র রাজনীতি শেষ করতে হয়। এজন্য কমিটির শেষদিকে এসে অর্থ উপার্জনের নেশা ও হতাশা থেকে তাদের মধ্যে অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে রোব ও সোমবার একাধিকবার কল করা হলেও তারা তা রিসিভ করেননি। পরে ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাকিব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রলীগ অনেক বড় একটি ছাত্র সংগঠন। এখানে দু-চারটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে না তা নয়। তবে অপরাধীদের কখনোই ছাড় দেওয়া হয় না। কিন্তু আমরা তো যাচাই-বাছাই ছাড়া কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না। এখন দেখা যায়, কিছু হলেই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে অভিযোগ করা হয়। ছোট ঘটনাকে বড় করা হয়। মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে আমাদের বিচার হওয়ার আগেই তাদের বিচার হয়ে যায়। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া এবং সময় ঠিক করে দেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যখন বলবেন, ছাত্রলীগ তখনই সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত। নবগঠিত কমিটিগুলো নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ইদানীং যেখানে কমিটি হয় সেখানেই এমন অভিযোগ আসে। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে কাবা শরিফের ইমামকে নেতা বানালেও তাকে নিয়ে একটি শ্রেণি বিতর্ক তৈরি করবে। এ অবস্থার কারণ হলো মূল দলের স্থানীয় নেতাদের যিনি কমিটিতে ভাগ পান না, তিনিই এমন বলেন। আবার ভাগ বুঝে পেলে এখন যাকে বিতর্কিত বলা হচ্ছে, সেই ভালো হয়ে যায়।

সূত্র: যুগান্তর

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com