ঈদ আনন্দ যেন দুঃস্বপ্ন, মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছেন বানভাসিরা
মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা কদিন পরেই। করোনা মহামারির কারণে কিছুটা কম হলেও সারা দেশে বিরাজ করছে ঈদের আমেজ। কিন্তু এ আমেজ পুরোপুরি উধাও বন্যাকবলিত নেত্রকোনা জেলায়।
ভয়াবহ বন্যায় প্রায় ১০ লাখ পরিবার পানিবন্দি। সরকারি হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার ৫৫০ জন মানুষ। তিন সপ্তাহের বেশি সময় জেলার মানুষ বানের পানিতে ভাসছেন। বানের পানিতে চোখের পলকে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে সহস্রাধিক পরিবার। এ অবস্থায় বানভাসিদের ঈদের আনন্দ পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে।
জেলার বেশিরভাগ জনপদে এখনও থইথই করছে বন্যার পানি। ফলে ঈদের আমেজ অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। আনন্দের বদলে ভোগান্তির ঘোলা জলে হাবুডুবু খাচ্ছেন হাওড়পারের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষ। পানিতে ভাসা বেশিরভাগ মানুষের সাধ্য নেই এবারের ঈদে পশু কুরবানি দেওয়ার।
বানভাসিদের মতে, যেখানে জীবনই বাঁচে না, সেখানে কীসের ঈদ। তারা তাকিয়ে আছেন সরকারি-বেসকারি সাহায্যের দিকে। যদিও ঈদ উপলক্ষ্যে ভিজিএফসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ত্রাণ দিয়ে বন্যাকবলিত মানুষের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
খালিয়াজুরী উপজেলার মুজিবনগর আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রধানমন্ত্রীর উপহারের জমিসহ ঘর পেয়েছিলেন দিলাল মিয়া (৪৫)। আশায় বুক বেঁধেছিল বাকি জীবন সুখে থাকার। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। বন্যায় ঘরের ভেতর এক বুক পানি সামলিয়ে উঠলেও এখন শুরু হয়েছে ঢেউয়ের তাণ্ডব। সরকারের দেওয়া ঘরের বেশিরভাগ অংশ ধসে গেছে। বাকিটুকুও যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।
দিলাল মিয়া বলেন, বন্যার পানি, আফাল ঢেউয়ের তাণ্ডবে ঘুমাইতে পারি না— কখন বাড়ি, স্ত্রী-সন্তানকে বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অর্ধেকটা ভেঙে গেছে, সাপ-বিচ্ছুর ভয়। ঢেউয়ের বিকট শব্দ খুব ভয় লাগে। ঈদের কোনো চিন্তাও মাথায় নেই। ঈদ বানের জলে ভেসে গেছে আমাদের।
শুধু তিনিই নন, তার মতো বন্যায় আধাপাকা ঘর ভেঙেছে একই গ্রামের কদর মিয়া, জাকির মিয়া, আল আমিন ও মমতাজ বেগমসহ মুজিবনগর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৯২ বাসিন্দার। অনেকেরই ঈদের আনন্দ তাদের কাছে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এখনো দুর্ভোগে রয়েছেন ওই উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ।
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার গাঁওকান্দিয়া গ্রামের রোমেনা খাতুন (৪২)। তিনি বলেন, ঘরের বিছানার ওপর হয়ে যায় এক বুক পানি। উপায়ান্তর না দেখে সন্তানকে নিয়ে ভাসতে থাকি পানিতে। আধাঘণ্টা পর একটি আমগাছে ওড়না দিয়ে ছেলেকে বেঁধে রাখি। নিজে গাছে লটকে থাকি। ৭ ঘণ্টা পরে নৌকা দিয়ে লোকজন তুলে নিয়ে গেছে। ঘরগুলোও এক এক করে চোখের সামনে ভেসে গেছে। নেওয়া হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। পানি কমলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে আর কিছুই পাননি। ঘরবাড়ি, গাছপালা— এমনকি ভিটেটাও নেই। রোমেনা খাতুনের কিছু নেই। ঈদ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই তার। জীবনযাপনের নিশ্চয়তা এখন নেই তাদের।
ঈদ কেমন কাটবে, এমন প্রশ্ন করতেই অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে যান রোমেন খাতুন। পাশে সন্তানরা। চুপ হয়ে গেলেন সবাই। কিছু সময়ের নীরবতা ভেঙে রোমেনা বললেন, ‘দ্যাহেন, আমরার ঈদ আর অন্যদিন হমান। সামর্থ্য অইলে কেউর ঘরে একটু নাশতা-ফিন্নি রান্ধন অইবে, অনেকের ঘরেই অইবে না। নতুন কাপড়, ফিন্নি, ভালো খাওন, এই রহম ঈদকরণের ভাগ্য কি আর আছে। সব তো ভাসাইয়া নিয়ে গেছে।’ বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি।
একই গ্রামের সোমেশ্বরী নদীর পারে ৪০ শতক জমিতে স্বপ্নের মতো বাড়ি করেছিলেন চায়না হাসান (৩৮)। এক সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে সাজানো-গোছানো সংসার। ফুলে ফলে ভরা বাড়িটিকে স্বর্গ মনে হতো তার। ১৭ জুন সকাল ৮টার দিকে হঠাৎ বন্যার পানিতে সন্তানকে নিয়ে ভেসে যান তিনি। ২০ মিনিট পর বাঁশ ঝাড়ে আটকে থাকেন ৬ ঘণ্টা। এরই মধ্যে বানের পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব কিছু। মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই তার। কারণ পানির স্রোতে ভিটের মাটি চলে দিয়ে গর্ত হয়েছে অন্তত ৩০-৪০ ফুট গভীর। সামনে ঈদের কথা জিজ্ঞেস করতে দুচোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে তার।
শুধু তারাই নন, হারিয়াউন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুল ইসলাম, তার ভাই রহিত মিয়া, আব্বাস উদ্দিন, মুসলিম উদ্দিন, আব্দুল খালেক সরকার। সবার ঘরবাড়ি এখন স্মৃতি। জানতে চাইলে তারা নির্বাক তাকিয়ে থাকেন! তার পর বলেন, ‘ঘরবাড়ি,গাছপালা, জমি কিছুই নেই! কোথায় গিয়ে উঠবেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে? কি খাওয়াবেন স্ত্রী-সন্তানকে? বলেই কান্না শুরু করেন তারা। শুধু তারাই নন, তাদের মতো বাড়িঘর হারিয়েছে সীমান্তের দুই উপজেলার অন্তত ছয় শতাধিক পরিবার। বন্যার পানিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব কিছুই।
একই গ্রামের পল্লী চিকিৎসক ইসলাম উদ্দিন বলেন, ১৭ জুন সকালে নামাজ পড়ে একটু ঘুমিয়ে যায়। হঠাৎ ৮টার দিকে দুই নাতি ও ছেলের বউকে নিয়ে ভাসতে থাকি পানিতে। মুহূর্তে ঘর গাছপালা ভেসে যেতে দেখে প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ওদের বাঁচাতে সাহস করে সাঁতার দিই। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় লোকজন নৌকা দিয়ে উদ্ধার করে। ১৫ লাখ টাকা খরচ করে ঘর বানিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, ঈদে ছেলে বাড়ি আসলে ঘরে উঠব। ঘর ভেঙে নিয়ে গেছে। এভাবেই ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ভাসিয়ে নেওয়ার কথা বলছিলেন, অন্যান্য দিনের মতো পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন সবাই। কিন্তু গভীর রাতে অকস্মাৎ নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাতের অন্ধকারে ঢলের পানি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সবাইকে। ছেলে নারায়ণগঞ্জ চাকরী করে ঈদে বাড়ি এলে ছেলে, স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে নতুন ঘরে ওঠা হবে না আর।