কলেজ শিক্ষককে পুলিশের উপস্থিতিতে জুতার মালা পরানোর ঘটনা কীভাবে ঘটল?
বাংলাদেশের নড়াইল জেলায় কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর পুলিশ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
স্থানীয় পুলিশ ঘটনার বেশ কয়েকদিন পর নাশকতা এবং শিক্ষককে হেনস্তা করার অভিযোগে মামলা করেছে।
ইসলামের নবীকে নিয়ে মন্তব্যের জন্য সমালোচিত ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার সমর্থনে ফেসবুকে নড়াইলের ওই কলেজের এক ছাত্রের পোস্টকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ১৮ই জুন।
সেদিন সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে বিক্ষোভ থেকে নড়াইল জেলা এবং পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই ঐ শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে।
জেলা এবং পুলিশ প্রশাসনের র্শীষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনা কীভাবে ঘটলো- এই প্রশ্নে এখন তোলপাড় চলছে।
শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর ঘটনাটি ঘটেছে নড়াইল সদর উপজেলায় মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজে। তিনি ঐ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।
কলেজটির এক হিন্দু ছাত্রের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভের এক পর্যায়ে ঐ ছাত্র এবং শিক্ষক মি: বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে কলেজ ভবন থেকে বের করে আনার ঘটনার কিছু ছবি এবং ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ওই ভিডিওতে সেখানে পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেছে। ঘটনার সময় নড়াইলের জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিস্থিতি সামলাতে সেখানে গিয়েছিলেন।
ঘটনার নয় দিন পর মামলা
ঘটনার নয় দিন পর স্থানীয় পুলিশ বাদি হয়ে নাশকতা এবং শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করার অভিযোগে মামলা করেছে। গ্রেপ্তার করা সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের দু’টি তদন্ত কমিটি এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে বলেও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, শিক্ষককে যেখানে জুতার মালা পরানো হয়েছে, সেখান থেকে তিনি এবং পুলিশ সুপার কিছুটা দূরত্বে ছিলেন: “আসলে আমি এবং এসপি মহোদয় ছিলাম মূল গেটে। সেখান থেকে মাঠ এবং তারপর কলেজ ভবন, সেখান থেকে তাদের নিয়ে আসা হয়”।
তিনি বলছেন বিক্ষোভের উত্তেজনা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছ বলে তারা মনে করছেন।
“স্থানীয় জনগণের অভিযোগ ছিল যে প্রিন্সিপাল মহোদয় সকাল থেকেই ঐ ছেলেটাকে বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা সামাল দিতে পারেননি। সেখানে দুর্বলতা বা অন্যান্য বিষয়ে অভিযোগে তার (অধ্যক্ষ) প্রতি আক্রোশটা বেশি ছিল।”
ঘটনা আকস্মিক, দাবি পুলিশের
পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় বলেছেন, ১৮ই জুন সকাল থেকে সারাদিন ঐ কলেজে মুসলিম শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় এবং আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে। তাতে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন দল ও সংগঠনের লোকজনও অংশ নিয়েছিল। তারা বিক্ষোভে লাঠিচার্জ এবং কাঁদানে গ্যাসও নিক্ষেপ করেছিলেন।
কিন্তু গুলি চালিয়ে বলপ্রয়োগ করা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে তারা সে পথে যাননি বলে জানান মি. রায়।
পুলিশ সুপার দাবি করেছেন, শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে বের করে আনার সময় বিক্ষোভকারীদের কেউ আকস্মিকভাবে হয়ত ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
“আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি, যাতে গুলি না করে বা রক্তপাতহীনভাবে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের রেসকিউ (উদ্ধার) করা যায়। “কারণ ওখানে গোলাগুলি হওয়ার পর যদি কোন ঘটনা ঘটতো, তাহলে ঐ অঞ্চলে হিন্দু মুসলামান দাঙ্গা ছাড়িয়ে পড়ত এবং সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ত বলে আমরা মনে করেছি, বলেন মি. রায়।
তিনি বলেন, তাদের মূল চেষ্টা ছিল, পরিস্থিতি শান্ত করে দ্রুত সেখান থেকে অধ্যক্ষকে উদ্ধার করা।
কলেজের অধ্যক্ষকে উদ্ধারের সময় সেখানে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কেউ দ্রুত জুতার মালাটি পরিয়ে দিয়েছে বলে তাদের ধারণা। তিনি বলেন, পরে জুতার মালা পুলিশের নজরে আসার সাথে সাথেই তা সরিয়ে ফেলা হয়।
‘বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে’
পুলিশ সুপার অবশ্য ঘটনার পেছনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগের পাশাপাশি কলেজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকেও একটি কারণ বলে ধারণা করছেন।
“ঘটনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিষয় আছে, এলাকার রাজনৈতিক বিষয় আছে, তারপরে কলেজের ম্যানেজিং কমিটির বিষয়ও আছে। সব মিলিয়ে চারদিক থেকে বিষয়টি একটা কঠিন আকার ধারণ করেছিল,” বলেন নড়াইলের পুলিশ সুপার।
তিনিও এও বলেন যে, কোন মহল দেশে কোন পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা থেকেও ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে।
পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠার পর সেটাকে ব্যবহার করে অনেকে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেছে।
কলেজটির ব্যবস্থাপনা কমিটিরও একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ঘটনার পেছনে শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয় থাকতে পারে।
যে শিক্ষকের দিকে এমন ইঙ্গিত করা হচ্ছে, তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা। তবে ঐ শিক্ষক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তাদের শিক্ষকদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। ঐ শিক্ষক অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক চিন্তা থেকে বিএনপি এবং জামায়াত ঘটনায় জড়িত ছিল। স্থানীয় বিএনপি এবং জামায়াত এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তবে ঘটনা সম্পর্কে ঐ শিক্ষক আরও বলেন, তাদের কলেজের একজন হিন্দু ছাত্র ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যের সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছেন। এই অভিযোগে গত ১৮ই জুন কলেজের মুসলিম শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় লোকজনের বিক্ষোভের মুখে হিন্দু ছাত্রটি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মি: বিশ্বাসের অফিসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
“সে সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন-এমন অভিযোগে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভ থেকে উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটে,” জানান ঐ শিক্ষক।
এলাকার এমপি যা বলেছেন
নড়াইল সদর এলাকার সংসদ সদস্য বি এম কবিরুল হক বলেছেন, “ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে। কিন্তু আমরা আওয়ামী লীগ এবং প্রশাসনের লোকজন দিন শেষে এটাকে সামলাতে সক্ষম হয়েছি এবং এই আগুনকে আমরা চাপা দিতে সমর্থ হয়েছি।”
শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছেন। তার পক্ষে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মি: বিশ্বাস তদন্ত কমিটির কাছে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
আর যে হিন্দু ছাত্রের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে ঘটনাটি ঘটেছে, সেই ছাত্র ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে মাদ্রাসার একজন শিক্ষকের করা মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন।
কর্মকর্তারা বলেছেন, কলেজটি যে এলাকায়, সেখানে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে এবং ঘটনার পরদিন থেকেই পরিবেশ স্বাভাবিক রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি