সিলেট-সুনামগঞ্জে নামছে পানি, বাড়ছে দুর্ভোগ
উজানের পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও পয়োনিষ্কাশনের সংকটে ভুগছেন বানভাসি মানুষেরা। সুরমা নদীর পানি সোমবার (২৭ জুন) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচে ছিলো। যদিও কানাইঘাট পয়েন্টে এখনো শূন্য দশমিক ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আবার কুশিয়ারা নদীর পানি একেবারে ধীর গতিতে কমছে।
কিছু এলাকায় কমলেও অমলসীদ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ওসমানীনগর, দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও বালাগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উন্নতি হয়েছে গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর ছাড়া বাকি সব কটি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সবদিকেই নদ-নদীর পানি কমছে। কুশিয়ারার পানি একেবারেই ধীর গতিতে কমছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, তেমন উন্নতি বলা যাচ্ছে না। আর সুনামগঞ্জে পানি বেশি থাকায় সিলেট থেকে পানি নামতে সময় লাগছে। তবে আশা করা যাচ্ছে সপ্তাহখানেকের মধ্যে পানি নেমে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আপাতত কোরবানির ঈদের আগে আর পানি বাড়ার সম্ভাবনা নাই। ঈদের ঢলের পানি নামতে পারে। তবে এতটা না।’
১৫ জুন থেকে সিলেট-সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বন্যায় সিলেট নগরীর অধিকাংশ, সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ ও সিলেটের ৮০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়।
এদিকে, সোমবার সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মূল সড়কগুলো থেকে পানি নেমে গেলেও পাড়া-মহল্লার ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে আছে। এসব পানিতে ময়লা জমে কালো রং ধারণ করেছে। বাসিন্দারা এসব পানি মাড়িয়েই চলাফেরা করছে। এ ছাড়া, নগরীর ছড়া, খালগুলো ময়লা-আবর্জনা পড়ে পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতার তৈরি হয়েছে। নগরীর প্রায় সবগুলো ছড়া-খালে পানির ওপর ময়লা-আবর্জনা ভেসে থাকতে দেখা যায়।
একই অবস্থা সুনামগঞ্জ শহর ও সিলেটের সব’কটি উপজেলা শহরেরও। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরে ফেরা নিম্ন আয়ের মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে। কাচা ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে আসবাবপত্রও। এ ছাড়া, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পাগলা বাজার থেকে হাসন রাজার তোরণ পর্যন্ত রাস্তা দু’পাশে ত্রিপল দিয়ে ছাউনি দিয়ে গবাদিপশুর সঙ্গে বসবাস করছেন শত শত বন্যার্ত পরিবার।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের জয়কলস ইউনিয়নের নোয়াগাঁও (কাকিয়ারপাড়) গ্রামের শামছুন নুর জানান, ‘বন্যার পনিতে ডুবে এক শ’ মণ ধান শেষ হয়ে গেছে। গত ১০ দিন ধরে রাস্তায় থাকছি। এখনো ঘরের ভেতরে পানি। মানুষের দেওয়া ত্রাণ দিয়ে কোনোক্রমে চলছে দিন। অনেকেই পাতলা পায়খানা, চুলকানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। চারদিকে শুধু পচা গন্ধ। সবাই অসুস্থ হবে। সরকারি কোনো ত্রাণ সহায়তা পাইনি। আমাদের গ্রামের সবারই এক অবস্থা। এ সময় একই গ্রামের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।’
সিলেট সদর নীলগাঁওয়ের ফুল বিবি জানান, ‘৬ জনের পরিবার। একমাত্র ছেলে দুলাল মিয়া সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালায়। বছরের শুরুতে এফআইভিডিবি থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছিলেন। সপ্তাহে ৪ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। বন্যায় ঘর ভেঙে গেছে। সকল জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ঘর ঠিক করব না কিস্তি চালাইব? আর খেয়ে বাচঁবোই কীভাবে।’
কানাইঘাটের গাছবাড়ি আমরপুর গ্রামের বাসিন্দা মানোয়ারা বেগম বলেন, ‘সবে আইয়া রাস্তার খান্দার মানশরে ত্রাণ দিয়া যায় গিয়া। আমরা হউ বন্দর মাঝে বাড়ি, কুনতা ফাইনা। ফানিয়ে ঘর-দোয়ার ভাঙ্গিলিছে। ওখন খাইমু কিলা আর ঘর ঠিক করতাম কিলা। আমার তো খামাইয়ারাও (রোজগার) নাই।’
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের পাছালী গ্রামের নুরুজ্জামান বলেন, ‘পানি এক জায়াগায় আটকে আছে। বাড়ছেও না, কমছেও না। এক সপ্তাহের বেশি সময় ঘরের ভেতর পানি। এভাবে আর কত দিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা যায়? সহ্য-ধৈর্য শেষ।’
ফেঞ্চুগঞ্জের উপজেলার ঘিলাছড়া ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের রুমেল আহসান জানান, ‘কুশিয়ারার পানি বাড়ায় পুরো এলাকা বন্যায় প্লাবিত। পানি সহজে কমছে না। বিশুদ্ধ পানি, খাবার মিলছে না। জীবন অসহায় হয়ে পড়েছে।’