তুর্কি-সৌদি সম্পর্কে বরফ গলছে?
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সৌদি আরব সফর করতে পারেন। এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক উষ্ণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে এরদোয়ানের ব্যক্তিগত বৈরিতারও অবসান হতে পারে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে।
২০১১ সালের আরব বসন্তের পর কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা নিরসনে বিগত বছরগুলোতে কাজ করছে তুরস্ক। এসব দেশের মধ্যে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। মুসলিম ব্রাদারহুডকে তুরস্কের সমর্থনের কারণে আরব দেশগুলো রাজনৈতিক ইসলামকে একটি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। এতে করে তুরস্কের সঙ্গে তাদের বৈরিতা শুরু হয়।
সর্বশেষ ২০১৭ সালে তুরস্কের মিত্র কাতারের ওপর উপসাগরীয় দেশগুলোর অবরোধ আরোপে এই বিচ্ছিন্নতা আরও বাড়ে। বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও সৌদি আরব গত বছর এই অবরোধ প্রত্যাহার করে। এতে করে দেশগুলোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ সুগম হয়।
জামাল খাশোগি ফ্যাক্টর
সৌদি আরবের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আরেকটি ঘটনা প্রভাব রাখছিল। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুল কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড। এই হত্যার ঘটনায় সৌদি আরবের ডি ফ্যাক্টো নেতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ওপর চাপ বাড়ে ও বৈশ্বিক নিন্দার ঝড় উঠে। এক বছর আগের মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাশোগিকে হত্যা বা বন্দি করার অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন খোদ যুবরাজ। সৌদি সরকার সব সময় তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে আসছে।
সরকারপন্থী তুর্কি সংবাদমাধ্যম ও এরদোয়ান যুবরাজের নাম উল্লেখ না করে বলতে থাকে, সৌদি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে কিলিং স্কোয়াড কাজ করেছে। সৌদি আরবের একটি আদালত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এক রায়ে ৮ ব্যক্তিকে কারাদণ্ড দেয়। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এই বিচারের নিন্দা জানিয়েছে। তুরস্ক নিজেরা সন্দেহভাজন ২৬ সৌদি নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা ও তদন্ত জারি রাখে।
গত সপ্তাহে এই বিচার স্থগিত ও সৌদি আরবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে সম্পর্ক উষ্ণ করার প্রধান বাধা দূর করা হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি আবুধাবির মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মনিকা মার্কস বলেন, এটিই ছিল সবচেয়ে বড় বাধা। নিশ্চিতভাবে গত ছয় মাসে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, আঞ্চলিক সম্পর্ক উষ্ণ করার ক্ষেত্রে সৌদি আরবের সঙ্গে নিশ্চিত অগ্রগতিই ছিল সবচেয়ে বড় বাধা। এর পেছনে জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে ব্যক্তিগত বিরোধের গভীরতা ও আক্রমণের ভূমিকা রয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে এরদোয়ান যখন সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন তখন তাকে ধুমধামের সঙ্গে স্বাগত জানানো হয়। এর আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ওই মাসেই সৌদি আরব সফর করবেন। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। আমিরাত থেকে ফেরার পথে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন সৌদি আরবের সঙ্গে ইতিবাচক সংলাপ চলমান রয়েছে।
তুরস্কের সংবাদমাধ্যম সম্প্রতি জানিয়েছে, এরদোয়ান রমজান মাসে সৌদি আরব সফর করবেন। যা অগ্রগতির স্পষ্ট নিদর্শন হবে।
এছাড়া সম্পর্কে অগ্রগতির আরও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলু ২০২১ সালের মে মাসে সৌদি আরব সফর করেন। এর আগের মাসেই তিনি সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, আগামী সময়ে সম্পর্কোন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অর্থনৈতিক তাগিদ
সৌদি আরবে সরকারি ঘোষণা ছাড়াই তুর্কি পণ্য বয়কট চলছিল। এর ফলে দেশটিতে তুরস্কের রফতানি ৯০ শতাংম কমে যায়। গত মাসে সৌদি আরবের সঙ্গে তুরস্কের বাণিজ্য ছিল ৫৮ মিলিয়ন। আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ হলেও ২০২০ মার্চের ২৯৮ মিলিয়নের তুলনায় নগন্য।
তুরস্কের এই কূটনৈতিক উদ্যোগের নেপথ্যে দেশটির বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের ভূমিকা রয়েছে। করোনা মহামারির পর এখন ইউক্রেন যুদ্ধ। সরকারি মূল্যস্ফীতি ৬১ শতাংশে পৌঁছেছে, তুর্কি মুদ্রা লিরার দরপতন হয়েছে। ২০২১ সালে ডলারের বিপরীতে মূল্য কমেছে ৪৪ শতাংশ এবং এই বছর কমেছেআরও ১০ শতাংশ।
এরদোয়ানের আমিরাত সফরের আগেই তুরস্ক আবুধাবির সঙ্গে ৪.৯ বিলিয়ন ডলার মুদ্রা বিনিময় চুক্তি নিশ্চিত করেছে। কাতার, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও দেশটি এমন চুক্তি করেছে। আমিরাত ঘোষণা দিয়েছে তুরস্কে ১০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা বিনিয়োগের।
তুরস্কের আহি এভরান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ফ্যাকাল্টি সদস্য ইয়ুপ এরসয় বলেন, সৌদি আরবের কাছ থেকে বিনিয়োগ পুঁজি নিশ্চিত করতে চাইছে তুরস্ক। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট তুরস্কের সরকারকে চাপে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে তুরস্কের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে।
আঙ্কারাভিত্তিক ওরসাম সেন্টার ফর মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের উপ-পরিচালক ইসমাইল মনে করেন, এরদোয়ানের সৌদি আরব সফর বোঝাপড়ার পরিবেশ পুনরায় তৈরি করবে। রাজনৈতিক গুরুত্ব, অর্থনৈতিক সামর্থ ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের বিচারে এ অঞ্চলে দেশ দুটি বড়। এই সফরে সহযোগিতার বিষয় প্রাধান্য পাবে।
আঞ্চলিক সম্প্রীতি
মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মনিকা মার্কস-এর মতে, উভয় দেশের জন্য পুনরায় ঘনিষ্ঠ হওয়া রাজনৈতিকভাবে যৌক্তিক এবং অর্থনৈতিকভাবে মুনাফাজনক। অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার নিরিখে মহামারি বিভিন্ন দেশের সরকারকে আরও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় নীতিতে পরিবর্তন এসেছে।
তিনি আরও বলেন, এই অপ্রত্যাশিত আঞ্চলিক সম্প্রীতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হয়েছে। সেটি হচ্ছে, তিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট– ওবামা, ট্রাম্প ও বাইডেন– চাহিদামতো ইরানের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সফরের ফলে এরদোয়ান ও সৌদি যুবরাজের ব্যক্তিগত অনাস্থাও দূর হতে পারে বলে মনে করেন মনিকা মার্কস। তিন বলেন, আস্থা অর্জনের চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে এরদোয়ানের কাছে যুবরাজের চূড়ান্ত প্রত্যাশা হতে পারে খাশোগির হত্যা মামলা সৌদি আরবের হাতে তুলে দেওয়া। যুবরাজের নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন ছিল যে এরদোয়ান এই ইস্যু নিয়ে আর বিরোধ বাড়াবেন না।