রাজধানীতে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

0

রাজধানী ঢাকাতে বেড়ে গেছে ছিনতাই। সেই সঙ্গে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্যরা। সেই সাথে বেড়ে গেছে বড় বড় অপরাধ। এসব অপরাধ দমনে কাজ করছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, রাজধানীতে বেপরোয়া ৭৮ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এর সংখ্যা প্রায় ২ হাজারের বেশি। তারা সংঘবদ্ধ একটি চক্র।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবীতে হত্যার শিকার হন গার্মেন্টস কর্মী রায়হান ওরফে রাজ। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে দুইজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলো- রাতুল (১৫) ও অনিক (১৫)। গ্রেফতারের পরে পুলিশ জানায়, আটককৃতরা কিশোরগ্যাংয়ের সদস্য। তাদের বয়সও ১৫ এর মধ্যে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিসি (মিরপুর বিভাগ) আ স ম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রায়হান হত্যাকাণ্ড ছিল ক্লুলেস। সে সময় কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি। পল্লবী থানা এলাকায় জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, ভিকটিম ও আসামি পল্লবী থানার পলাশ নগর এলাকার বাসিন্দা। ওই এলাকা থেকে সিসিটিভি ফুটেজের সহায়তায় একজনকে শনাক্ত করা হয়। টেকনোলজি ব্যবহার করে আমরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত রাতুলকে শনাক্ত করতে সক্ষম হই। এবং ম্যানুয়ালি টেকনোলজিকালি কাজ করে পল্লবী থানা পুলিশ আসামিদের গ্রেফতার করে।

ডিসি বলেন, এ ঘটনায় আমরা জানতে পেরেছি আসামি রাতুল পলাশ নগর এলাকার বখাটে ছেলে ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। সে সব সময় মদ্যপান অবস্থায় থাকতো। পোশাক শ্রমিক রায়হানের মোবাইল নেওয়ার জন্যই ছুরিকাঘাত করে রাতুল। আসামিদের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছে কিনা সে বিষয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করছি। যদি কেউ জড়িত থাকে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

জানতে চাইলে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) কর্মকর্তা পারভেজ ইসলাম বলেন, ঘটনাস্থলে ভুক্তভোগী রায়হানের গতিরোধ করে রাতুল ও অনিক। রায়হানের মোবাইল চায় আসামিরা। পরবর্তীতে রায়হানের মোবাইল দিয়ে অন্যত্র ফোন করতে চায়। মোবাইলে টাকা না থাকায় মোবাইলটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এক এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় ভুক্তভোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, আসামিরা নিজেদের এলাকার কারো কাছ থেকে ছিনতাই করতো না। রায়হানকে একটি পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী ফিরে যাওয়ার সময় আসামি রাতুলকে ধাক্কা মেরে চলে যায়। পরবর্তীতে আসামি দৌড়ে গিয়ে রায়হানকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।

তিনি বলেন, অভিযুক্তরা কিশোরগ্যাংয়ের সদস্য। ঘটনার সঙ্গে অন্য জড়িতদের গ্রেফতারে কাজ করা হচ্ছে। শুধু এ হত্যাকাণ্ডই নয়, রাজধানীতে কিশোরগ্যাংরা যে বেপরোয়া তা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আগেই ভাবিয়েছে।

তথ্য মতে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সারা রাজধানীতে ৭৮ টি এ ধরনের কিশোর গ্যাংয়ের গ্রুপ শনাক্ত করেছে। পাশাপাশি কাদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তারা চলে তাদেরও চিহ্নিত করেছে। এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থা।

পুলিশের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে মিরপুর এলাকায়। আর সবচেয়ে কম গুলশানে। এছাড়া তেজগাঁও বিভাগে যথাক্রমে ১৪টি, মিরপুরে ২৩, উত্তরায় ১১, গুলশানে ১, ওয়ারীতে ৬, মতিঝিলে ১১, রমনায় ৮ এবং লালবাগে ৪টি গ্রুপ চিহ্নিত হয়েছে। সদস্যদের পাশাপাশি পৃষ্ঠপোষক বা রাজনৈতিক গডফাদারদের নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

পুলিশের হালনাগাদ তালিকায় সদস্যদের পাশাপাশি কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক বা রাজনৈতিক গডফাদারদের নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক পদ, পদবি ও নাম-ঠিকানাসহ এবং মোবাইল নম্বর যুক্ত করে কে কোন গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক তার বিস্তারিত বিবরণও রয়েছে এ তালিকায়। এতে যেসব রাজনৈতিক নেতার নাম উঠে এসেছে তাদের বেশির ভাগই পাড়া-মহল্লার উঠতি নেতা বা পাতিনেতা হিসাবে পরিচিত।

এছাড়া বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নাম আছে তালিকায়। তবে সূত্রগুলো বলছে, কোনো কোনো গ্রুপের নেপথ্যে রয়েছে একেবারে বড় মাপের প্রভাবশালী নেতা। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় তাদের নাম তালিকায় স্থান পায়নি।

কিশোর গ্যাং গ্রুপের পৃষ্ঠপোষক যারা

পুলিশের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক শেল্টারদাতা বা পৃষ্ঠপোষক হিসাবে অর্ধশত ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। কেউ কেউ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে সুবিধার জন্য সরকারি দলের সাইনবোর্ড সর্বস্ব পদ-পদবিও নিয়েছেন। তালিকায় নাম আছে এমন নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিল্পাঞ্চল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি জিল্লুর রহমান ওরফে জীবন, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তালুকদার সারোয়ার হোসেন, মোহাম্মদপুর এলাকার চন্দ্রিমা হাউজিং ও সিলিকন হাউজিংয়ের মালিক ছারোয়ার ও নাজিব আমজাদ এবং গ্রামবাংলা হাউজিংয়ের মালিক কবির, ড্রিমল্যান্ড হাউজিংয়ের মালিক সাদিকুর রহমান ওরফে বকুল, শেরেবাংলা নগর থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদ। আদাবর এলাকার ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল কাশেম, ১০০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি পাপ্পু।

রাজধানীতে ৭৮ কিশোর গ্যাং এর সক্রিয় সদস্য

রাজধানীর তেজগাঁও থানা এলাকায় সক্রিয় গ্রুপ ১৪টি। এর সদস্য সংখ্যা ১০৫০ জন। গ্রুপের নামগুলো হলো-কানা জসিম গ্রুপ, মাইন উদ্দিন গ্রুপ, শাকিল গ্রুপ, মামুন গ্রুপ, লাড়া-দে, চিনে ল, কোপাইয়া দে, বাঁধন গ্রুপ, পলক গ্রুপ, গাংচিল, ঘুটা দে, চেতাইলেই ভেজাল, দ্যা কিং অব গাইরালা, ভইরা দে এবং অনলি কোপাইয়া দে গ্রুপ।

এছাড়া মিরপুরে সক্রিয় ২৩টি গ্রুপ। এগুলো হলো-অপু গ্রুপ, আব্বাস গ্রুপ, নাডা ইসমাইল, হ্যাপি, বগা হৃদয়, ভাস্কর, রবিন, এল কে ডেভিল বা বয়েজ এল কে তালতলা, পটেটো রুবেল, অতুল গ্রুপ, আশিক গ্রুপ, জল্লা মিলন গ্রুপ, রকি, পিন্টু-কাল্লু গ্রুপ, মুসা হারুন গ্রুপ ওরফে ভাই ভাই গ্রুপ, রোমান্টিক গ্রুপ, সোহেল গ্রুপ, ইয়ামিন, ইমন ও জুয়েল গ্রুপ।

উত্তরা বিভাগে মোট ১১টি গ্রুপ পুলিশের তালিকাভুক্ত হয়েছে। এগুলো হলো-নাইন স্টার, এইচবিটি বা হিটার বয়েজ, সানি, ইয়ংস্টার, বিগ বস, রানা ভোলা কিং মহল, জিদান গ্রুপ, দি বস (হৃদয় গ্যাং)। নামবিহীন আরও ২টি গ্রুপ শনাক্ত করেছে পুলিশ। গুলশান এলাকায় ডি নাইন নামের মাত্র একটি গ্রুপ শনাক্ত করেছে পুলিশ। এর সদস্য সংখ্যা ৩০ জনের বেশি।

রমনা বিভাগে ৮টি গ্রুপের নাম হচ্ছে বেইলী কিং রন, অলি গ্রুপ, জসিম, লাভলেন, বাংলা গ্রুপ, পারফেক্ট গ্যাং স্টার বা পিজিএস, সুমনের গ্রুপ এবং লাড়া-দে। এছাড়া ওয়ারী বিভাগের ৬টি গ্রুপ চিহ্নিত করা হয়।

এগুলো হচ্ছে-শুক্কুর গ্রুপ, লিটন গ্রুপ, তাহমিদ, পলাশ, মোল্লা এবং সাঈদ গ্রুপ। রাজধানীর ব্যাংকপাড়া হিসাবে পরিচিত মতিঝিল এলাকায় ১১টি কিশোর গ্যাং পুলিশের তালিকাভুক্ত। এগুলো হলো-মিম গ্রুপ, চাঁন যাদু, ডেভিল কিং, ফুল পার্টি, জিসান গ্রুপ, বিচ্ছু বাহিনী, আকিল ও অন্নয় গ্রুপ, নিবিড় গ্রুপ, মাসুদ গ্রুপ। এছাড়া সক্রিয় আরও ৩টি গ্রুপের নাম জানা যায়নি। লালবাগ বিভাগে জুম্মন গ্রুপ, বহুল আলোচিত টিকটক হৃদয়, আহম্মেদ পাত্তি গ্রুপ, ইয়ামিন, ফায়সাল ও নাসির গ্রুপ নামের মোট ৪টি গ্রুপ সক্রিয়।

পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত একেকটি কিশোর গ্যাংয়ের নাম দেখলে রীতিমতো অবাক হতে হয়। অদ্ভুত এবং ভয়ংকর সব নাম। অনেক গ্রুপের নামের সঙ্গে আবার সরাসরি খুনখারাবি অথবা মারধরের ট্যাগ যুক্ত। যেমন মাইরালা, কোপায়া দে ইত্যাদি। রাজধানীতে ৭৮ গ্রুপের এ ধরনের ভয়ংকর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ২ হাজারের বেশি।

পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের অদ্ভুত সব নামের কী মর্মার্থ তা অনেকেরই জানা নেই। তবে নামের ধরন দেখে তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যে কারও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লিডারের নামে গ্রুপের নামকরণ হয়ে থাকে। ইভটিজিং, মারধর, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ছাড়াও মাদক ব্যবসা, ছিনতাই এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাং। তাদের উৎপাত আর অপরাধ কর্মকাণ্ড দিন দিন বাড়ছে। অনেক এলাকায় কিশোর গ্যাং সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।

রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত এবং তালিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, এখন দেখা যাচ্ছে, উঠতি বয়সী ছেলেরা নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ছোটখাটো ছিনতাই থেকে শুরু করে মাদক সেবন, মেয়েদের টিজ করা এমনকি নিজেদের মহল্লায় জুনিয়র-সিনিয়র সংঘাতে খুন পর্যন্ত হচ্ছে। সম্প্রতি এটা আরও বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই আমরা তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

তিনি বলেন, এখন এটা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। তাই শুধু পুলিশ একা নয়, যারা সমাজ নিয়ে ভাবেন তাদের সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে অভিভাবকদের উচিত হবে সমস্যা লুকিয়ে না রেখে তারা যেন যথাসময়ে পুলিশের সহায়তা নেয়।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com