ঋণখেলাপিদের আগ্রাসী থাবায় জর্জরিত ব্যাংক খাত

0

তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলেছে ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য। তাদের আগ্রাসী থাবায় জর্জরিত ব্যাংক খাত। দীর্ঘ সময়ে ঋণখেলাপির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে খেলাপি ঋণ। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।

এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৯ শতাংশ।

এখন প্রায় সব ব্যাংকেই খেলাপি ঋণের থাবা বসেছে। এমন কি নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণের করাল গ্রাসে চলে যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণখেলাপিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৫২৮ জনে। ২০২০ সালের একই সময়ে ছিল ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৯৮২ জন। গত এক বছরে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ২৫ হাজার ৫৪৬ জন। ২০১৮ সালের জুনে এ সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ জন। আলোচ্য দুই বছর তিন মাসে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৩২৪ জন। এর মধ্যে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে দুই ধরনের ঋণখেলাপিই রয়েছেন। বিশেষ করে বড় ঋণের পাশাপাশি এখন ছোট ঋণও খেলাপি হচ্ছে। এছাড়া অনেক খেলাপির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। অস্তিত্ববিহীন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিদেশে পাচার করে দেওয়ায় খেলাপি হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলসহ (আইএমএফ) এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য আড়াল করছে। বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরও বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঋণ পরিশোধের সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেলে সেগুলো বিশেষ হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার ছয় থেকে নয় মাসের মধ্যে পরিশোধিত না হলে তা খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

আইএমএফ ও বিশ্লেষকদের মতে, বিশেষ হিসাবে থাকা ঋণও খেলাপি হিসাবে ধরা উচিত। কেননা এগুলোও ছয় থেকে নয় মাসের মধ্যে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ হিসাবে রয়েছে ৪৭ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এছাড়া অবলোপন করা আছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে আটকে আছে ৮০ হাজার কোটি টাকার ঋণকে খেলাপি হিসাবে দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করা ঋণের মধ্যে ২১ হাজার কোটি টাকা আবারও খেলাপির পর্যায়ে চলে গেছে। এগুলোও খেলাপি হিসাবে গণ্য করার মতো। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করে না। এসব মিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৯২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের প্রায় ২৪ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ব্যাংকিং খাতকে প্রতিযোগিতা করতে হলে মান ও সুশাসনে আরও উন্নত করতে হবে। কমাতে হবে প্রকৃত খেলাপি ঋণ। রাজনৈতিক বা প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। দেশের ব্যাংকিং খাত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা পেলে বৈদেশিক লেনদেনে তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি লাগবে না। তখন ব্যবসা খরচও কমে যাবে।

২০১৯ সালের ২৪ জুন আদালতে দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে খেলাপি ও অকার্যকর ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরাসরি খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে বিভিন্ন আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। যাতে এসব ঋণ খেলাপি করা না হয় এবং ৩০ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে।

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য ঋণ বিতরণের অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, সুশাসনের অভাবকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৪ সালে এ ঋণ বেড়ে প্রথমবারের মতো ৫০ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আলোচ্য সময়ে বেড়েছে ২৭ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১২৩ দশমিক ১০ শতাংশ।

এর মধ্যে ২০১১ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে তা বেড়ে ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক মন্দায় ওই বছরে খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছিল।

২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৯ সালের জুনে তা বেড়ে প্রথমবারের মতো লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকায়। জুনে তা কমে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকায় নামে। আলোচ্য সময়ে এ ঋণ বেড়েছে ৪৪ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ৮৮ দশমিক ০৮ শতাংশ।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে কমলেও ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা আবার বেড়ে লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আলোচ্য পৌনে ২ বছরে বেড়েছে ৬ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।

তুমি এটাও পছন্দ করতে পারো

উত্তর দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com